ভেঙে পড়েছে নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী দুবলহাটি রাজবাড়ীর একাংশ
সংরক্ষণের অপেক্ষায় থাকা নওগাঁ সদর উপজেলার শত বছরের ঐতিহ্য দুবলহাটি রাজবাড়ীর একাংশ ভেঙে পড়েছে। গত সোম ও মঙ্গলবার প্রবল বর্ষণের সময় রাজবাড়ীর মূল ফটকের পশ্চিম পাশে দোতলার তিনটি কক্ষের ছাদ বিমসহ ভেঙে পড়ে। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় একশ বছর আগে দুবলহাটির রাজা হরনাথ এই রাজবাড়ি তৈরি করেন। এর পর দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে ছিল বাড়িটি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই রাজবাড়ি কিছুটা সংস্কার করে সংরক্ষণের জন্য রেখেছিল।
তবে এরপর দীর্ঘদিনেও কোনো সংস্কারকাজ না করায় প্রবল বর্ষণের মধ্যে আকস্মিকভাবে রাজবাড়ীর একাংশ ভেঙে পড়ে। আর এই ভাঙনের কারণে দীর্ঘদিন অযত্ন আর অবহেলায় কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে এই পুরাকীর্তি।
এবারের ধসের ফলে রাজবাড়িটিতে দর্শনীয় আর তেমন কিছুই বাকি রইল না।
দীর্ঘদিন রাজবাড়িটি ছিল পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। শুধু যথাযথ নজড়দারি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রাচীন এই রাজবাড়ি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হচ্ছে। অথচ এই প্রাসাদে ছিল শতাধিক ঘর। ছিল সাতটি আঙিনা আর রাজরাজেশ্বরী মন্দির।
দুবলহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান জানান, ধসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। জেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে দ্রুত রাজবাড়ীর সংস্কারকাজ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, ঘটনাটি জানতে পেরে তাঁরা রাজবাড়ী পরিদর্শন করেছেন। বিষয়টি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।
এদিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বগুড়ার আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা জানান, ওই রাজবাড়ী প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরেই ওই বাড়ির মালিকানা নিয়ে হাইকোর্ট স্থিতবস্থা জারি করেন। ফলে সেখানে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। মালিকানা নিয়ে মামলা নিষ্পত্তি হলেই কেবল সেখানে কাজ করতে পারবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী দুবলহাটি রাজবাড়ী। রাজা হরনাথ রায় চৌধুরী ও তাঁর পুত্র রাজা কৃঙ্করীনাথ রায় চৌধুরীর সময় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয় রাজ স্টেটের। রাজপ্রাসাদের সামনে রোমান স্টাইলের বড় বড় পিলারগুলো রাজাদের রুচির পরিচয় বহন করত। ১৮৬৪ সালে রাজপরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরে স্কুলটির নামকরণ হয় রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয়।
লোকমুখে প্রচলিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, রঘুনাথ নামের এক ব্যক্তি লবণ ও গুড়ের ব্যবসা করতেন। তিনি দীঘলি বিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত খয়রা নদী দিয়ে নৌকায় করে দুবলহাটিতে ব্যবসার কাজে যেতেন। তিনি প্রায় রাতে স্বপ্ন দেখতেন যে কেউ তাঁকে বলছে, যেখানে তিনি নৌকা বাঁধেন, সেখানে পানির নিচে একটি প্রতিমা আছে। সেই রাজরাজেশ্বরী দেবীর প্রতিমাটি সেখান থেকে তুলে স্থাপন করতে হবে।
সেইমতো রঘুনাথ একদিন ভোরবেলা জলে নেমে দেখলেন সত্যিই সেখানে রাজরাজেশ্বরীর প্রতিমা আছে। তিনি প্রতিমাটি একটি মাটির বেদি তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করলেন এবং নিয়মিত পূজা করতেন। এরপর তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করল। রঘুনাথের বিত্ত-বৈভবের খবর জেনে যায় মোগল দরবার। মোগল দরবারের নির্দেশে তাঁকে ডেকে পাঠান মুর্শিদাবাদের নবাব। নবাব তাঁকে রাজস্ব প্রদানের হুকুম জারি করেন। তিনি নবাবকে জানান তিনি যে এলাকায় থাকেন, সেখানে শুধু জল আর জল। কোনো ফসল হয় না। তবে বড় বড় কৈ মাছ পাওয়া যায়। বিষয় বুঝতে পেরে নবাব তঁকে প্রতিবছর রাজস্ব হিসেবে ২২ কাহন কৈ মাছ প্রদানের নির্দেশ দেন।
রাজা কৃঙ্করীনাথ রায় চৌধুরীর নাতি ও কুমার অমরেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরীর ছেলে দুবলহাটি রাজপরিবারের ৫৪তম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী (৭৬) জানান, তাঁদের জমিদারি ছিল সিলেট, দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও ভারতের কিছু অংশে। হরনাথ রায় চৌধুরী রাজা খেতাব পেয়েছিলেন। এর আগের পূর্বপুরুষরা মোগলদের দেওয়া জমিদার খেতাবে ভূষিত ছিলেন। ২২ কাহন কৈ মাছ দিয়ে রাজস্ব প্রদানের বিষয়টি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে অন্তর্ভুক্ত আছে বলেও জানান তিনি।