সোনা পাচারের স্বর্গ সাতক্ষীরা সীমান্ত, দুই পারে ১০৬ কেজি জব্দ
চোরাচালানিদের ভাষায় ‘সেফ মাল’। কখনো লালি, আবার কখনো চকলেট। যে সাংকেতিক নামেই ডাকা হোক, এটি যে সোনা তা বুঝতে বাকি থাকে না কারো। এই সোনা এখন দখল করে নিয়েছে সাতক্ষীরা সীমান্ত।
সোনা চোরাচালানের নিরাপদ করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সাতক্ষীরার জল ও স্থলসীমান্ত। এপার থেকে যাচ্ছে সোনা, আর ওপার থেকে আসছে বিভিন্ন পণ্য।
গতকাল শুক্রবার রাতেও সাতক্ষীরার বৈকারী সীমান্তে আতাউর রহমান নামে এক ইউপি সদস্য ১২ পিস সোনার বারসহ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবির) হাতে ধরা পড়েছেন। ওই সময় তাঁর এক সঙ্গী আটক ও মোটরসাইকেল জব্দ করেছে বিজিবি। এভাবে পাচারকালে একের পর এক সোনার চালান ধরা পড়ছে সীমান্তে।
কম জায়গা লাগায় খুব সহজেই সোনা পাচার করা যায়। তাই এর নাম ‘সেফ মাল’। সরাসরি ঢাকা থেকে আসছে কথিত এই সেফ মাল। সাতক্ষীরার সিন্ডিকেট তা রিসিভ করছে। তারপর পাচার করছে ভারতে। সাতক্ষীরা সীমান্তে সোনা পাচারের চিত্র দীর্ঘদিনের। আর এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রভাবশালীরা। তাঁদের কেউ চেয়ারম্যান, কেউ রাজনীতিক, কেউ গডফাদার। এই প্রভাবশালীদের আছে বিস্তৃত সিন্ডিকেট ও যোগাযোগ। আবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক অসাধু সদস্য এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন।
সাতক্ষীরা সীমান্তে ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ২০ কেজি সোনা ভারতে পাচারকালে জব্দ করা হয়েছে। একই সময়ে সাতক্ষীরার বিপরীতে ভারতের পশ্চিম বাংলার বসিরহাটে ভারতীয় পুলিশ জব্দ করেছে আরো ৮৬ কেজি সোনা। সেখানে গ্রেপ্তার হওয়া চোরাচালানকারীরা স্বীকার করেছেন, এই সোনা সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে নেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা সীমান্ত সোনা পাচারের নিরাপদ করিডর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা আটক করছে তা সোনা পাচারের তুলনায় খুবই নগণ্য বলে ধারণা করা হয়।
২০১৩ সালের ২৭ মে কলারোয়ার কেড়াগাছিতে ৭০ তোলা সোনা আটক করে বিজিবি। একই বছরের ৫ ডিসেম্বর ৪৯ তোলা সোনাসহ কলারোয়ার ভাদিয়ালী গ্রামের মো. নাসিরউদ্দিন নামের এক চোরাচালানি সাতক্ষীরা শহরের লস্করপাড়ায় ধরা পড়েন। ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তলুইগাছা সীমান্তের খেলার মাঠের কাছে ৬০ তোলা সোনাসহ কেড়াগাছি গ্রামের জাকির হোসেন নামের এক চোরাচালানিকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি। সে বছরের ২৩ মে কলারোয়ার চান্দুড়িয়া সীমান্তের গয়ড়া বাজারে বিজিবির তাড়া খেয়ে মোটরসাইকেলে এক কেজি সোনার পোটলা ফেলে পালিয়ে যায় চোরাচালানিরা। বিজিবি তা উদ্ধার করে। একই বছরের ৩০ জুলাই দেবহাটার খানজিয়া সীমান্তে ৮৪ তোলা সোনা ভারতে পাচারকালে আটক করেন বিজিবি সদস্যরা। ওই বছরেরই ২৩ সেপ্টেম্বর শহরের হাসপাতাল মোড়ে ৩০ তোলা সোনার তিনটি চকলেট বারসহ মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের সুমন, সাতক্ষীরা শহরের কামালনগরের মারুফ হাসান ও আবদুর রউফসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এদিকে ২০১৫ সালের ১৭ এপ্রিল ২৪০ তোলা ওজনের ২৪টি সোনার বার মাটিতে পুঁতে রাখা অবস্থায় জব্দ করে বিজিবি। একই বছরের ৩ জুলাই কলারোয়ার কাকডাঙ্গা সীমান্তে চোরাচালানি জহুরুল হক দশটি সোনার বার ও একটি সোনার চেইনসহ গ্রেপ্তার হন। জহুরুল আটক থাকা অবস্থায় তাঁর ভাই আজহারুল সাড়ে সাত কেজি সোনার ছয়টি প্যাকেট তাঁর মেয়ে সুমির কাছে একটি ব্যাগে রেখে দেন। খবর পেয়ে ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর বিজিবি সোনার ৬০টি চকলেট বার জহুরুলের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে। এর আগে ২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার ভোমরা লক্ষমদাঁড়ি থেকে ইউসুফ আলী নামের এক চোরাচালানিকে দুটি সোনার বারসহ গ্রেপ্তার করে বিজিবি। এদিকে ২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি ভোমরায় সোনার ১২টি বারসহ জয়দেব ঘোষ নামের এক চোরাকারবারিকে বিজিবি গ্রেপ্তার করে।
এদিকে গত ২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাতক্ষীরার ভাদড়া মোড়ে চোরাচালানিদের ফেলে যাওয়া এক ব্যাগ সোনা রাস্তার আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা নাজমুল হোসেন তা কুড়িয়ে নেওয়ার সময় ডিবি পরিচয়ে এক ব্যক্তি তা হাতিয়ে নেন। এ নিয়ে মারামারি হয়। নাজমুলকে গ্রেপ্তার করা হলেও শেষ পর্যন্ত সেই সোনার আর কোনো হদিস মেলেনি। অপরদিকে একই সালের ২৬ আগস্ট ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা নেওয়ার সময় সাতক্ষীরার সংগ্রাম পরিবহনে তল্লাশি চালিয়ে মাগুরা জেলা পুলিশ আট কেজি সোনাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশকে তারা জানায়, সাতক্ষীরার জনৈক দাদুর কাছে এই সোনা পৌঁছে দেওয়ার কথা। পুলিশ সেই দাদুর সন্ধানে সাতক্ষীরায় অভিযান চালালেও তাঁকে গ্রেপ্তারের কোনো খবর জানায়নি।
২০১৪ সালের ৯ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বসিরহাটে ৪৫ কেজি সোনাসহ গ্রেপ্তার হন দেশটির গোল্ড সিন্ডিকেট প্রধান বারিক বিশ্বাস। তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী কলকাতার বড় বাজারে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় পুলিশ আরো ৪১ কেজি সোনা জব্দ করে। বারিক বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এই সোনা বাংলাদেশের সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে পাচার করে নেওয়া হয়। বিষয়টি ভারতীয় গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছিল।
সীমান্ত পথে সোনাপাচার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির ৩৮ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল আরমান হোসেন বলেন ‘সব ধরনের চোরাচালানরোধে বিজিবি সদস্যরা বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সীমান্তজুড়ে বিজিবির কড়া নজরদারি রয়েছে। এ ছাড়া চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারেও অভিযান চলছে। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত না হতে সীমান্তে প্রায়ই জনসচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয়।