তিন বছর পর ইতালি প্রবাসী হত্যারহস্য উদঘাটন পিবিআইয়ের
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/04/29/gopalganj_unraveling_the_mystery_of_death_photo-.jpg)
গোপালগঞ্জে ইতালি প্রবাসী হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পিবিআই। তিন বছর আগে ইতালি প্রবাসী বাচ্চু শেখ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারান। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অজ্ঞান পার্টির মূলহোতা আমির হোসেন তিন বছর আগের ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেছেন পুলিশের কাছে। তিনিসহ তিনজন এ ঘটনায় জড়িত বলেও জানিয়েছেন।
গতকাল রোববার গোপালগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রুবেল শেখের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার আমির হোসেন।
আমির হোসেনের বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার ভিমের পাড় (মাহিলারা) গ্রামে। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় চেতনানাশক ঔষধ প্রয়োগ করে বিদেশ ফেরত অনেক মানুষকে অজ্ঞান করে মালামাল চুরির ঘটনায় ইতোমধ্যে ১৩টি মামলা হয়েছে।
আজ সোমবার গোপালগঞ্জের পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, ২০২১ সালের ৮ মার্চ ছুটিতে ইতালি থেকে বাচ্চু শেখ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে পরের দিন ৯ মার্চ ভোরে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। এ সময় আমির হোসেনসহ অজ্ঞান পার্টির তিন সদস্য বাচ্চু শেখের পিছু নেন। এয়ারপোর্ট থেকে আব্দুল্লাহপুর বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে বাচ্চু শেখ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার তপারকান্দি গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে হানিফ এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে ওঠেন। তাঁকে ফলো করে অজ্ঞান পার্টির ওই তিন সদস্য আবদুল্লাহপুরে গিয়ে বাচ্চুর শেখের পাশের তিনটি সিটে অবস্থান করেন। সেখান থেকে বাসটিতে চরে সকাল সাড়ে ৯টায় গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের তপারকান্দি গ্রামের উদ্দেশে রওনা হন বাচ্চু শেখ। বাসে বসে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ইতালি প্রবাসী বাচ্চু শেখের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। বাচ্চু শেখের কাছে ফোন না থাকায় আরিচা ফেরিঘাটে পৌঁছে অজ্ঞান পার্টির এক সদস্যের ফোন দিয়ে বাচ্চু শেখ তাঁর স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ঢাকা-বরিশাল রুটের বরিশালগামী হানিফ এন্টারপ্রাইজের বাসে বাড়ি আসার বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর তাঁকে কৌশলে বিস্কুটের মধ্যে নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে বাচ্চু শেখকে খাইয়ে অজ্ঞান করে তাঁর লাগেজ ও মূল্যবান মালামাল নিয়ে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দের মোড়ে নেমে যায় অজ্ঞান পার্টির তিন সদস্য। পরে অচেতন অবস্থায় বাচ্চু শেখকে বাসের সুপারভাইজার মিরাজ খান গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার ছাগলছিড়া গ্রামের ১৪ নং ব্রিজের নিকট বাচ্চুর শেখের স্ত্রী রাবেয়া বেগমের নিকট বুঝিয়ে দিয়ে বাসটি বরিশালের দিকে চলে যায়। অসুস্থ অবস্থায় বাচ্চু শেখকে প্রথমে মাদারীপুর জেলার রাজৈর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে ওই রাতেই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পাঁচ দিন পর বাচ্চুর স্ত্রী রাবেয়া বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মুকসুদপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। মুকসুদপুর থানা পুলিশ ক্লুলেস হত্যা মামলার কোনো রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় পুলিশ হেডকোয়ার্টারের আদেশে ২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল বাচ্চু শেখ হত্যা মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় গোপালগঞ্জ পিবিআইকে। পিবিআইয়ের দুই কর্মকর্তা বদলিজনিত কারণে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ মামলাটি ২০২১ সালের ৪ ডিসেম্বর তদন্তের দায়িত্ব দেন পিবি আইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) ফিরোজ আহমেদকে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর পিবিআইইয়ের এসআই ফিরোজ আহমেদ এ ঘটনায় তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় একটি মোবাইল ফোন কলের সূত্র ধরে তদন্ত চালিয়ে গত ৫ মার্চ কামাল হোসেনকে গোপালগঞ্জ পিপিআই অফিসে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে কামাল হোসেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। পরবর্তী সময়ে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলার আসামি আমির হোসেনসহ মোট তিনজনকে আসামি শনাক্ত করেন। অজ্ঞান পার্টির সদস্য আমীর হোসেনকে গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনাকালে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় জানা যায়, এরা গত ১৩ এপ্রিল দুবাইফেরত যাত্রী মাইনুলের (৩৬) সঙ্গে বাসের মধ্যে বসে সখ্যতা তৈরি করে যাত্রীকে নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে বিস্কুট ও ডাবের পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করলে তিনি ও বাসের লোকজন অজ্ঞান পার্টি সদস্য আমির হোসেনকে মারপিট করে কুমিল্লা সদর থানায় সোপর্দ করেন। এরপর কুমিল্লা থানায় তাঁর বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করে আদালতের মাধ্যমে আমিরকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ ইতালি প্রবাসী বাচ্চু শেখ হত্যার ঘটনার সঙ্গে আসামি আমিরের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাঁকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিজ্ঞ আদালতে রিমান্ডের আবেদন করেন। বিজ্ঞ আদালত আসামিকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডের সময় জিজ্ঞাসাবাদে দীর্ঘ তিন বছর পরে অজ্ঞান পার্টির মূলহোতা আমির হোসেনসহ জড়িত তিনজনকে শনাক্ত করেন এই কর্মকর্তা। অজ্ঞান পার্টির সদস্য আমির ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন। গতকাল রোববার অজ্ঞান পার্টির সদস্য আমির হোসেন গোপালগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. রুবেল শেখের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় বাচ্চু শেখ হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে বিজ্ঞ বিচারক মো. রুবেল শেখের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে আমিরকে জেলহাজতে পাঠান।
প্রাথমিক তদন্তকালে জানা যায়, আসামি আমির হোসেন অজ্ঞান পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি এই পেশায় প্রায় ১৩ বছর ধরে জড়িত।
আমির ও তার দলের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিমানবন্দরে বিদেশফেরত যাত্রীদের টার্গেট করেন এবং তাদের সঙ্গে সখ্য তৈরি করে কৌশলে বিস্কুট ও ডাবের পানির মধ্যে নেশা জাতীয় ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে অজ্ঞান করে যাত্রীদের সঙ্গে থাকা মালামাল চুরি করে আসছিল।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পিবিআইয়ের গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, পিপিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের দিকনির্দেশনায় একের পর এক ক্লুলেস হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন সম্ভব হয়েছে।