ভৈরব রেল সেতু ধ্বংস করে পাকিস্তানি সেনারা
আজ ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে এই দিন দুপুর দেড়টা থেকে ২টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ভৈরবের মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতুটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এতে রেল সেতুর ভৈরব অংশের দুটি স্প্যান ও আশুগঞ্জ অংশের একটি স্প্যান ভেঙে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ও ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি আলহাজ মো. সায়দুল্লাহ মিয়া এনটিভি অনলাইনকে জানান, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার আজবপরে যৌথ বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ভৈরবের আগানগরের জগমোহনপুরে তাঁর ক্যাম্পে ফিরছিলেন। এ সময় সেতু উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাটি ঘটে। তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে তখন মেঘনা নদী পাড়ি দিচ্ছেলেন।
পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে রাজধানী ঢাকার দিকে অগ্রসরমান বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর অগ্রগামিতায় বাধা সৃষ্টি করতে হানাদার বাহিনী এই সেতু ধ্বংস করে দেয়। এর আগে ২ ডিসেম্বর ভারতীয় যুদ্ধবিমান দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ভৈরবে সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর কয়েকবার হামলা চালায়।
৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর পূর্বাঞ্চল সেক্টর আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চরম মার খেয়ে প্রায় ১০/১২ হাজার পাকিস্তানি সেনা আশুগঞ্জ পাড়ি দিয়ে ভৈরবে আশ্রয় নেয়। হানাদার বাহিনীর ধারণা ছিল, ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা রেল সেতু দিয়ে হেঁটে ভৈরবে আক্রমণ করবে। এ কারণে ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে তারা সেতুর তিনটি স্প্যান ভেঙে দেয়।
এ ছাড়া এদিন পাকিস্তানি সেনারা ভৈরবের তৎকালীন ন্যাশনাল বর্তমান সোনালী ব্যাংকের ট্রেজারি ডিনামাইটের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়ে টাকা-পয়সা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। অন্যান্য ব্যাংকের টাকাও পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা লুট করে নিয়ে যায়। এসব ছাড়াও এদিন হানাদাররা ভৈরব টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, রেলওয়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের মারাত্মক ক্ষতি করে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র তিন দিন আগে পাকিস্তানি সেনারা ভৈরবে এ তাণ্ডব চালায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছর পর পুনর্নির্মাণ শেষে ১৯৭৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেতুটি উদ্বোধন করেন। তখন সেতুটির নামকরণ করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার আবদুল হালিমের নামে ‘শহীদ আবদুল হালিম রেলওয়ে সেতু’।
জানা যায়, তৎকালীন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই দিন সেতুটির নতুন নামকরণ করার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর নামে। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান সেতু উদ্বোধন করতে গিয়ে জানতে পারলেন, এখানে যুদ্ধ চলাকালীন এক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তাঁর নাম হাবিলদার আবদুল হালিম। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত পাল্টে সেতুটির নামকরণ করেন ‘শহীদ আবদুল হালিম রেলওয়ে সেতু’।
মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার শহীদ আবদুল হালিমের বাড়ি চাঁদপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে তরপুচণ্ডী গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আলী হোসেন। হাবিলদার আবদুল হালিম ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর তৎকালীন কুমিল্লা জেলার কসবা থানার চাঁদপুর গ্রামে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন। সেই স্মৃতি ধরে রাখতেই সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজে এ সেতুর নামকরণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে।
শহীদ আবদুল হালিম ‘বীর বিক্রম’ উপাধি পেয়েছিলেন (সূত্র : জয় বাংলা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, বীর বিক্রম-৪৬)। বিষয়টি সবার অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর তাঁর পাওয়া খেতাবের পদক শহীদ হালিমের বাড়িতে পৌঁছানো হয়। তখনই এ শহীদ পরিবার বিষয়টি জানতে পারে। ১৯৯৬-এর ১৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে চার সদস্যের একটি সেনাদল পদক নিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়িতে যায়। শহীদ হালিমের মেজ ভাইয়ের কন্যা শাহীন আক্তার সেনাসদস্যদের কাছ থেকে পদকটি গ্রহণ করেন বলে জানা যায়।