‘এমপিওভুক্ত না হলে আমার বিয়ে হবে না’
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সৈয়দকাঠী ইউনিয়নের ইসলামিয়া কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রুনা খানম (৩৪)। বিএম কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে ২০০৮ সালে নিজের এলাকার এই কলেজে যোগ দেন দেশ গড়ার কারিগর হিসেবে। কারণ ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতা করা।
এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পরই রুনা খানম আশ্বাস পেয়েছিলেন, শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটি সরকারি সুবিধার তালিকাভুক্ত বা এমপিওভুক্ত হয়ে যাবে। তাই অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির কথা চিন্তা করেননি তিনি।
এর মধ্যে দশ-ভাই বোনের সংসারে রুনার বাবা মারা যান। ভাইয়েরা সবাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন।
এদিকে রুনার বয়স বাড়ছে, সমাজের হিসেবে বিয়ের বয়স পেরোচ্ছে, কিন্তু তা দেখার কেউ নেই! রুনা খানমের ভাষায় ‘উচ্চ শিক্ষিত হওয়ায় কেউ ভয়ে আসে না’ আবার ‘কেউ ঘৃণায় আসে না’।
অন্যদিকে রুনার পরেই রয়েছে আরো তিন বোন। তিনি বিয়ে না করলে ছোট তিন বোনেরও বিয়ে দিতে সমস্যায় পড়ছেন পরিবারের সদস্যরা।
ইসলামিয়া কলেজটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় সরকারের কাছ থেকে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না রুনা খানম। ফলে সংসার আর বৃদ্ধা মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড়ের জন্য টিউশনিই তাঁর একমাত্র ভরসা। এই মুহূর্তে রুনার পরিবারের সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর বিয়ে। যে কারণে ঘরে বসে থাকা আরো তিন বোনের জীবনেই নেমে এসেছে হতাশা। এসব বলতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন রুনা খানম। তিনি বলেন, ‘এমপিওভুক্ত না হলে আমার বিয়ে হবে না।’
আজ শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এনটিভি অনলাইনকে রুনা বলেন, ‘সংসারে বাবা নেই, উপার্জন নেই, ভাইয়েরা পৃথক সংসার করছে, আমিসহ চার বোন অবিবাহিত। আমার কারণে অন্য ছোটবোনেরা পড়াশুনা করতে আগ্রহী নয়। সবারই একই কথা, পড়ালেখা করে কী লাভ হলো? সরকারি চাকরির বয়স নেই, এখন চাইলে গার্মেন্টসেও চাকরি করতে পারি না। পরিবারে এখন অধিকাংশ সময় কাটে অনাহারে-অর্ধাহারে। প্রধানমন্ত্রীতো কত ঘোষণাই দিয়ে থাকেন। তাঁর একটি ঘোষণামাত্র বাঁচাতে পারে হাজার শিক্ষকের সম্মান। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হয়ে চাকরিটা ঠিকমতো হয় তখন দেখা যাবে অনেকেই বিয়ে করতে আসছে! অনেকেই তখন পাশে এসে দাঁড়াবে।’
কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে !
একইভাবে নিজের জীবনের হতাশা আর কষ্টের কথা তুলে ধরেন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলা সোনাপাতিল দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষিকা আতিয়া খানম বীথি (৩৬)। তিনি বলেন, ‘ডিগ্রি পাস করে ২০০৪ সাল থেকে এ মাদ্রাসায় যোগ দেই। বিয়ের এক বছরের মাথায় একটি পুত্র সন্তান হয় আমার। কিন্তু সংসারে অভাব অনটন শুরু হয়। স্বামী চিন্তা করে চাকরি করি, টাকা নেই কেন? এক সময় স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। হতাশা নেমে আসতে থাকে জীবনে। লালন-পালন করার মতো কোনো অবস্থা না থাকায় ছেলেকেও নিজের কাছে রাখতে পারিনি। প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো বেতন-ভাতা নেই। টিউশনি করে অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করছি। বাবা-মা কেউ আর জীবিত নেই। ভাইদের ওপর নির্ভরশীল। এমপিওভুক্ত না হলে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।’
আতিয়া খানম বীথি বলেন, ‘একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে থাকে তখন তাঁর চোখে শিক্ষার্থীরা দেশের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এখানে দিনের পর দিন রাস্তায় বসে আছি। কেউ আমাদের করুণার চোখে দেখছে, কেউ বা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে! এ পথ দিয়ে যাওয়ার পথে অনেকে এমনভাবে তাকায় যা শিক্ষক সমাজ ও দেশের জন্য লজ্জাজনক! এখন আমাদের হারানোর কিছুই নেই।’
একইভাবে জীবনের চরম কষ্টের কথা তুলে ধরেন পটুয়াখালীর সাঈদীয়া ইসলামিয়া কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফাহমিদা জাহান। তিনি বলেন, ‘গত ১৬ বছর ধরে আশায় বুক বেঁধে এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে যাচ্ছি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো আশার ফল দেখতে পাচ্ছি না। বাসা থেকে প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া প্রতিদিন ১০০ টাকা ভাড়া প্রয়োজন হয়। সেই টাকা স্বামীর কাছ থেকে নিতে হয় প্রতিদিন। এটা আমার জন্য অনেক কষ্টকর। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই পেলাম না।’
একে একে কথা হয় নাটোরের লালপুর উপেজলার ফরিদপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক আস্তুল হাসিমের (৩৮) সঙ্গে। শিক্ষকতার পাশাপাশি কৃষি কাজ করে সংসার চালান তিনি। একই কথা জানান পাবনার সুজানগর উপজেলার কাধোয়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এমএলএসএস মো. আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্কুল করি। এরপর ভ্যানগাড়ি চালিয়ে সংসার চালাই। কারণ স্কুল থেকে কোনো বেতন-ভাতা পাই না। দিনের পর দিন এভাবে কিভাবে সংসার চালাবো?’
সারা দেশের নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে শিক্ষক-কর্মচারীরা।
এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাইয়ের পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম আজ শিক্ষকদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।
আমরণ অনশন চালিয়ে যাওয়া শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মধ্যে শতাধিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ১১ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পাশাপাশি ৬৯ জনকে দেওয়া হয়েছে স্যালাইন।
গত ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তির দাবি জানান শিক্ষকনেতারা। তাঁদের অভিযোগ, বাজেটে এমপিওভুক্তির সুস্পষ্ট কার্যকর পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ জুন থেকে তাঁরা আমরণ অনশন শুরু করেন।
আমরণ অনশনের পঞ্চম দিনে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বললেন নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার। তিনি বলেন, সারা দেশে পাঁচ হাজার ২৪২টি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি) কর্মরত প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্তির দাবিতে গত ৫ জানুয়ারি অনশন চলাকালীন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একান্ত সচিব মো. সাজ্জাদুল হাসান, শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইনকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সব নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন।
তবে ২০১৮-১৯ প্রস্তাবিত বাজেটে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, এমপিওভুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। খবরটি সারা দেশের নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকরা আহাজারি-আর্তনাদে ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, তাই আগের ঘোষণা অনুযায়ী ১০ জুন পবিত্র রমজান মাসে সারা দেশ থেকে আসা শিক্ষকরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান গ্রহণ করেন। শিক্ষকরা পুলিশি বাধা, গ্রেপ্তার, বৃষ্টি-বাদল, রোদ ও ভ্যাপসা গরম, রাতে মশার কামড় খেয়ে রাজপথের ফুটপাতে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।