‘শুনানি করার অবস্থা নেই, হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছে’
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা নাইকো দুর্নীতি মামলার অভিযোগ গঠন করা হবে কি না, এ বিষয়ের ওপর দ্বিতীয় দিনের শুনানিকালে খালেদা জিয়ার আইনজীবী বলেন, ‘মওদুদ স্যারের সঙ্গে আমাদের অনেক স্মৃতি। আজকে লাশ আসবে। এ মুহূর্তে শুনানি করার মতো মানসিক অবস্থা আমাদের নেই। হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছে স্যার।’
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘যেহেতু মামলাটি স্পর্শকাতর। তাই ভবিষ্যতে যেন কোনো প্রশ্ন না উঠে, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখা দরকার।’
এ মামলার অন্যতম আসামি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মৃত্যুবরণ করায় আসামিপক্ষের সময় আবেদনকালে কেরানীগঞ্জের কারা ভবনে স্থাপিত ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ শেখ হাফিজুর রহমানের অস্থায়ী আদালতে এসব কথা বলেন আইনজীবীরা।
বেলা ১১টার দিকে পিনপতন নীরবতার মাধ্যমে অসুস্থ থাকা খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এ মামলার শুনানি শুরু হয়। কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কারাফটক থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার ভেতরে সংরক্ষিত এলাকায় কারা কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত নিয়মশৃঙ্খলা মেনে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের আদালতে প্রবেশ করানো হয়।
বিচারকের এজলাসের সামনে অস্থায়ী এ আদালতের বাঁ পাশে কাঠগড়ায় আসামি গিয়াস উদ্দিন আল মামুনসহ তিনজন উপস্থিত ছিলেন। ডানপাশে প্রসিকিউশন টিম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। মধ্যে ছিলেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার, সঙ্গে ছিলেন জয়নুল আবেদীন মেজবাহ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন মোশাররফ হোসেন কাজল।
আজ বেলা পৌনে ১১টা শুনানির শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত এ মামলার খালেদা জিয়ার অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানির জন্য আজ দিন ধার্য রয়েছে। গত তারিখে শুনানি শুরু হয়। আজকেও পুনঃশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার শুনানি করবেন।’
এ পর্যায়ে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতকে বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি; এ মামলার একজন আসামি এবং প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ স্যার মৃত্যুবরণ করেছেন। বিজ্ঞ আদালত আমরা আপনার কাছে নোটিশ আকারে একটি আবেদনও করেছি। মওদুদ স্যারের সঙ্গে আমাদের অনেক স্মৃতি। আজকে লাশ আসবে। এ মুহূর্তে শুনানি করার মতো মানসিক অবস্থা আমাদের নেই। হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছে, স্যার।’
জবাবে বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন বিষয়টি আমরা জানি। এখন এ মামলায় তো তাঁর অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি আগেই শেষ হয়ে গেছে। আপনি তো আজকে তাঁর পক্ষ শুনানি করছেন না।’
এ বক্তব্যের জবাবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ তালুকদার বলেন, ‘আইনি বিষয়ে এখানে জটিলতা আছে। এটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। শুনানির জন্য প্রস্তুতি আমার আছে। কিন্তু কোনো আসামি মারা গেলে তাঁর বিষয়ে থানা থেকে আদালতে নোটিশ পাঠানো হয় এবং এর পরই আদালত পরবর্তী কার্যক্রম করে থাকেন। এ পর্যায়ে এ মামলাটি শুনানি করা যুক্তসঙ্গত হবে কি না, বিজ্ঞ আদালত বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।’
এর জবাবে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘মওদুদ স্যার মারা গেছেন। তিনি এ মামলারও আসামি। এ মুহূর্তে আইনি প্রক্রিয়া হচ্ছে, তাঁর মৃত্যুর প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করা। যেহেতু মামলাটি স্পর্শকাতর। তাই ভবিষ্যতে যেন কোনো প্রশ্ন না উঠে, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখা দরকার। এ মুহূর্তে আইনি প্রক্রিয়া হচ্ছে- রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা।’
জবাবে বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ মুহূর্তে তো মওদুদ আহমদের সাক্ষী হচ্ছে না। সাক্ষী হলে হয়তো চিন্তা করা যেত। কিন্তু তাঁর বিষয়ে যেহেতু শুনানি হচ্ছে না, তাই মামলার কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে।’
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘মাননীয় আদালত, এ মুহূর্তে মানসিকভাবে আমরা ভেঙে পড়েছি। শুনানির করার মানসিক অবস্থা নেই। বিজ্ঞ আদালত, এক মিনিটে একটি গল্প বলি, আমাদের দেশ-গ্রামে বাপ-দাদারা দেখতাম; আগে দিনমজুর নিয়োগ দেওয়া হতো। তারা সকাল ৮টায় এসে কাজে যোগ দিত। কিন্তু যদি আসতে দেরি হতো, তখন বাপ-দাদারা বলত, দেরি হয়েছে সমস্যা নেই। তবে তুই বিকেলে দেরি করে যাবি; সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করাত। আমিও বলছি, পরবর্তী তারিখে অতিরিক্ত সময় নিয়ে শুনানি করব।’
এ পর্যায়ে প্রায় ১৫ মিনিট এ বিষয়ে উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের সম্মতি থাকায় পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২৫ মার্চ দিন ধার্য করেন। একইসঙ্গে ওই সময়ের মধ্যে গুলশান থানাকে মওদুদ আহমদের মৃত্যুর বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গত ২ মার্চ প্রথম দিনের এক ঘণ্টার শুনানির পর আজ বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) শুনানির দ্বিতীয় দিন ধার্য করেন আদালত। আজ শুনানি শেষে ২৫ মার্চ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতিসাধন ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম তেজগাঁও থানায় খালেদা জিয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাটি করেন।
২০১৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হয়। এতে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন সদ্য প্রয়াত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, প্রয়াত সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, বাগেরহাটের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ এইচ সেলিম ও নাইকোর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।