রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরির ‘নাটের গুরু’ বাংলাদেশি!
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/08/12/photo-1471022073.jpg)
গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য ১৯১৩ সালে বাঙালির প্রথম নোবেল জয় এসেছিল বিশ্বকবির হাত ধরে। পদকটি রাখা হয়েছিল কবির নিজের হাতে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী জাদুঘরে। কিন্তু ২০০৪ সালের এক রাতে নিরাপত্তার ঢিলেমির সুযোগে বাঙালি হিসেবে পৃথিবীর বুকে প্রথম স্বীকৃতির এই সোপান চিহ্ন নোবেল পদকটি খোয়া যায়।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরায়ণের রবীন্দ্র জাদুঘর থেকে রহস্যজনকভাবে ‘নোবেল পদক’সহ চুরি যায় কবির ব্যবহার্য অন্তত অর্ধশত মূল্যবান জিনিস। এর প্রায় ১২ বছর পর এই নোবেল চুরির বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা জানিয়েছে সিবিআই, সিআইডি এবং রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের গঠিত সমন্বিত সেল। তবে এই চুরির সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি তদন্তরত এই সংস্থা।
গতকাল বৃহস্পতিবার রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরির বিষয়ে সমন্বিত সেলের তথ্যের বরাত দিয়ে এ সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশ করে টাইমস অব ইন্ডিয়া। এরপর সংবাদ প্রতিদিন নামে কলকাতার একটি ওয়েবসাইটেও এই মামলার অগ্রগতির বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। পত্রিকাটি সিআইডি সূত্রের বরাতে জানায়, নোবেল পাচারের ‘নাটের গুরু’ ছিলেন বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মুহাম্মদ হোসেন শিপলু এবং ভারতীয় ব্যবসায়ী জীবন সিং। এ ছাড়া ওই দুজনের সঙ্গে এক ইউরোপীয় পাচারকারীরও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল বলে জানান ওই সিআইডি কর্মকর্তা।
এ ছাড়া টেলিফোন রেকর্ড এবং অন্যান্য সূত্রে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছে শান্তিনিকেতনে বসে বিচিত্রা চুরির ছক কষে ওই ‘নাটের গুরু’ চোরাচালান চক্রের অন্যদের জানায়। বাংলাদেশ ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গার বাসিন্দা ওই চোরাচালান চক্রের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেই ওই ব্যক্তি নোবেল চুরির ছক কষে। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক বিদেশি ব্যক্তির সম্পৃক্ততাও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। প্রাথমিকভাবে ওই ব্যক্তি জার্মানি বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশের নাগরিক বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের।
নোবেল চুরির তদন্তভার হাতে নেওয়ার আগেই ওই নাটের গুরুর সন্ধান শুরু করেছে সিআইডি। এক ইউরোপীয় ব্যক্তি ২০০৪ সালে শান্তিনিকেতনের ‘বিচিত্রা’-র সংগ্রহশালা থেকে নোবেল চুরির ‘মাস্টার প্ল্যান’ করে, এমন ইঙ্গিত আগেই পেয়েছিল সিবিআই।
সিআইডির ওই কর্মকর্তা আরো জানান, সেই সূত্র ধরে তদন্ত চালাবেন তাঁরাও। এমনকি, নোবেল ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত জিনিসপত্র চুরি করার পরিকল্পনা নিয়েই কাজে নেমেছিল ওই চোররা, ওই বিষয়েও নিশ্চিত হয়েছে সমন্বিত তদন্ত দল।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ওই আন্তর্জাতিক পাচারকারী দলের লক্ষ্য ছিল, চোরাপথে নোবেল এবং অন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো পাচার করে প্রথমে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া। সেখান থেকে নোবেল চোরাপথে ইতালি বা জার্মানির মতো ইউরোপের কোনো দেশে পাচার হয়েছে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না ভারতের গোয়েন্দারা। আবার হাত ঘুরে নোবেল আবার এই দেশেই ফিরে এসেছে, এমন সম্ভাবনাও রয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
এদিকে সংবাদ প্রতিদিন তাঁদের প্রকাশিত খবরে জানিয়েছে, গোয়েন্দাদের কাছে আসা খবর অনুযায়ী, ২০০৪ সালের মার্চ মাসে নোবেল চুরির আগে ‘বিচিত্রা’-র সংগ্রহশালায় বেশ কয়েকজন বিদেশিকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছিল। পর্যটক হিসেবেই তাঁরা সংগ্রহশালায় ঘুরে দেখেন।
নোবেল চুরির মূল ষড়যন্ত্রকারী ওই দলের সঙ্গে ‘বিচিত্রা’য় গিয়েছিলেন, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। আবার ওই ষড়যন্ত্রকারী একাও একাধিকবার ওই সংগ্রহশালা ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেন, এমন সম্ভাবনা গোয়েন্দারা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দাদের কাছে খবর, ওই ব্যক্তি নোবেল চুরির সময়ে শান্তিনিকেতনের কোনো হোটেল বা গেস্টহাউসে ছিলেন।
সিআইডির কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই তথ্যের সূত্র ধরে তদন্ত হাতে নেওয়ার পর বোলপুরের বড় হোটেল ও গেস্টহাউসগুলোতে গিয়ে ওই বিদেশিকে শনাক্তকরণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটি হলো, ২০০৪ সালে বহু হোটেলেই সিসিটিভি ছিল না। এত বছর আগেকার হোটেলের রেজিস্টার খাতা কর্তৃপক্ষ রেখে দিয়েছে কি না, তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।
ওই চুরির ঘটনার বর্ণনা জানা গেছে ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকার বরাতে। জানা গেছে, ২৫ মার্চ ২০০৪, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে প্রথম এই চুরির ঘটনা ধরা পড়ে।
আর দশটা দিনের মতো কর্মচাঞ্চল্যে মেতে উঠেছে শান্তিনিকেতন। যথারীতি ক্লাস করেছে বিশ্বভারতীর ছাত্ররা। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়ল নোবেল চুরি হয়েছে। সবাই ছুটল রবীন্দ্রনাথের বাড়ি উত্তরায়ণের দিকে। শুধু নোবেল কেন, আরো অনেক রবীন্দ্র স্মৃতি থেকে শুরু করে কবিগুরুর অনেক ব্যবহার্য জিনিসপত্র। এ উত্তরায়ণই আজ রবীন্দ্র সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালার কর্মচারীরা যখন ভবনের দ্বার খুলে দেন তখনই সবার চোখে পড়ে ব্যাপারটা। শুরু হয় হৈচৈ। গোটা রবীন্দ্র ভবন ঘিরে ফেলে পুলিশ। ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সেখান থেকে চুরি হয়ে গেছে রৌপ্যপদক, ওঁম লেখা সোনার আংটি, জামার সোনার বোতাম, কাফ লিঙ্ক, মৃণালিনী দেবীর শাড়ি, সোনা-বাঁধানো নোয়া, নোবেল পুরস্কারের পদক রুপার রেকাবি, রুপার কফি কাপ, সামুরাই তরবারি, কফি কাপ রাখার তেপায়া, চৈনিক চামুচ, কোবে শহর থেকে পাওয়া হাতির দাঁতের ঝাঁপিসহ আরো ৩৭টি জিনিস।
চুরির দিন ২৫ মার্চ ২০০৪ বুধবার ছিল শান্তিনিকেতনের ছুটির দিন। মঙ্গলবার দুপুর ১টায় বন্ধ হয়ে যায় শান্তিনিকেতন। বৃহস্পতিবার রবীন্দ্র ভবন খুলতেই ধরা পড়ে চুরির ঘটনা। কিন্তু কীভাবে চুরি হয় তা নিশ্চিত নয় পুলিশ। মঙ্গলবার বিশ্বভারতী বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই চোরেরা ভেতরে ঢুকে অবস্থান নেয়। সারা রাত ধরে মালপত্র সরাতে থাকে। রবীন্দ্র ভবনের পেছনের জানালা ভেঙে ফেলে চোর, দেয়ালের নিচে পাওয়া যায় ভাঙা গ্রিল। এই জানালা দিয়ে মালপত্র সরিয়ে নেয়। পুলিশ বলে, চোর জানালা দিয়ে ঢোকেনি। কারণ, সে ক্ষেত্রে জানালার পাল্লা ভেঙে ফেলতে হতো। উত্তরায়ণের এই বিশাল এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মাত্র দুজন এনডিএফ কর্মী। পাওয়া গেছে ২৮ জোড়া পায়ের ছাপ। তার মধ্যে আবার দুজনের পায়ে চটি ছিল। কিন্তু সেটিই রহস্য যেমন আজও উদ্ধার হয়নি, তেমনি খুঁজে পাওয়া যায়নি কবির পদকও।