একুশের টানে মিশে গেল দুই বাংলার সীমান্ত
আজও একুশের ডাকে যৌবন জাগে। একুশের ডাকে কাঁপে বাংলার মাটি। এ কথা ফের প্রমাণ করে দিল আরেকটা একুশের ফেব্রুয়ারির ভোর। আর এই দিনে ভাষার টানে যেন মিশে গেল দুই বাংলার সীমান্ত।
বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকায় মাথায় ফেটি বেঁধে নতুন প্রজন্ম বাংলা মায়ের মর্যাদা রক্ষার শপথ নিল। বাংলা ভাষা যে দুই বাংলার আপামর বাঙালির ‘আ-মরি বাংলা ভাষার’ সুর প্রমাণ করে দিল তা। এই দিনে তাই একই সুরে সুর দুই বাংলার নবীন প্রজন্ম তাল ধরল, ‘আমরা কজন নবীন মাঝি, হাল ধরেছি, শক্ত হাতে রে...।’ এটাই ছিল একুশের ভোরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বেনাপোল-পেট্রাপোলের খণ্ড চিত্র।
বাংলা ভাষার জন্য আত্মদান করা শহীদ ভাইদের স্মৃতি তর্পণে দুই বাংলার হৃদয়ে আজ সকাল থেকে ছিল একটাই সুর। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...।’
আর তাই হয়তো বছরের বারো মাসের কড়া নিরাপত্তার চোখ রাঙানির বাস্তবতা ভুলে সীমান্তের আজকের দিনটি ছিল একেবারেই ভিন্নধর্মী। কাতারে কাতারে মানুষের জনস্রোতে ভেঙেছে সীমান্তের কড়াকড়ির শেকল।
দুই দেশের নো-ম্যানস ল্যান্ডের মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দুই দেশের বাসিন্দারা অপরকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, কেমন আছেন ভাইজান? চোখের কোন নিমিষে ভাসল বোবা কান্নায়।
দুই দেশের বন্ধুদের একে অপরকে কাছে পাওয়ার অদম্য টান এদিন দূরে রাখতে পারেনি কাউকে। কাছে এসে পাশে দাঁড়িয়ে একে অপরের খোঁজ খবর নিলেন। স্মৃতিরোমন্থনে হারিয়ে গেলেন ক্ষণিকের তরে।
একাত্তরে শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে আসার পর দেশের গ্রামের লুৎফর চাচা আজও বেঁচে আছেন কি না তা যেমন খোঁজ নিলেন হাবড়ার অরুণ মুখোপাধ্যায়, তেমনি যশোরের মাহফুজুর রহমান খোঁজ নিলেন ৭১ সালে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভারতে চলে আসা প্রতিমা মাসি কেমন আছেন। ভাষা দিবসের একাত্মবোধ আরেকবার একুশের রক্তরাঙা ভোরে ভাস্বর হয়ে থাকল ভারত-বাংলাদেশের বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে।
‘দুই বাংলা মৈত্রী সমিতি’র তরফে শহীদ দিবস উপলক্ষে এদিন সীমান্তে আয়োজন করা হয় ভাষা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠান। যে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী চৌধুরী ইসমত আরা সাদেক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এস এম কামাল হোসেন, বেনাপোলের মেয়র আশরাফুল আলম লিটনসহ বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
আর পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, বনগাঁও উত্তর ও দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস, সুরজিৎ বিশ্বাস, বনগাঁও পুরসভার পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যসহ অনেকেই। দুই দেশের প্রতিনিধিরা এদিন সকালে সীমান্তের নো-ম্যানসল্যান্ডের শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। তারপর হয় মিষ্টি বিতরণ ও স্মৃতিবিনিময়।
বাংলাদেশের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক বলেন, ‘জন্মের পর থেকে আমাদের যে মা ডাক, সেই ডাককে কেড়ে নিতে চেয়েছিল হানাদার বাহিনী। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের রক্তের বিনিময়ে বায়ান্নতে সেই মা ডাককে ফিরে পেয়েছি আমরা। আজ সেই সমস্ত শহীদদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।’
মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘দুই বাংলার মধ্যে আজ সম্পর্ক বৃদ্ধি হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা মমতা দিদিকে ধন্যবাদ জানাই। কলকাতায় শহীদ মঞ্চ করে সেখানে ভাষাশহীদ ভাইদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হছে। দুই বাংলার এই মেলবন্ধনে আমরা আজ আপ্লুত।’
আশরাফুল আলম লিটন বলেন, ‘প্রতিবছর এই দিনটি আমাদের দুই দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা। এই দিনেই দুই দেশের মানুষই বাংলা ভাষার টানে একাত্ম হয়ে উঠি।’ বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘দুই বাংলা আজ একসুরে বাঁধা পড়েছে। আগামী দিনে এই ২১ ফেব্রুয়ারিতে যেমন দুই বাংলা সীমান্তে একাকার হয়ে যায় তেমনিভাবে আমরা বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রেখে বর্ষবরণ ও বসন্ত উৎসব করতে চাই। বাংলাদেশের ইলিশ দিয়ে বর্ষবরণ হবে।’ দুই বাংলার শিল্পীদের সমন্বয়ে আগামী দিনে আমাদের মধ্যে সংস্কৃতির বাঁধন আরো দৃঢ় হবে বলেও জানান তিনি।
বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘এক ভাষা, এক জাতি আমরা। সেটাই আমাদের সবথেকে বড় পরিচয়। এই ভাষার জন্য যাঁরা প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন তাদের ঋণ বাঙালি হিসেবে দুই বাংলার মানুষের অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই তো একুশের ভোরে বাংলাদেশের আপামর বাঙালির সাথে এপার বাংলার মানুষের হৃদয়ও কেঁদে ওঠে। তাই তো ওপার বাংলার মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শহীদ ভাইদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমরা ছুটে আসি এখানে।’ আগামী দিনে এই অনুষ্ঠানকে যাতে আরো বড় করে করা যায় সেই চেষ্টাই করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান বিধায়ক।