ব্যঙ্গ করতে গিয়ে গোপন সামরিক তথ্য টুইট করেছেন ট্রাম্প!
একজন রাষ্ট্রপ্রধান কেমন আচরণ করবেন তার সংজ্ঞা যেন নতুন করে লিখে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর আচরণকে কোনো ধরাবাঁধা ছাঁচে ফেলার জো নেই।
এই যেমন সম্প্রতি ট্রাম্প ইরানের প্রধান মহাকাশ কেন্দ্রের রকেট উৎক্ষেপণ স্থলের আশপাশের এলাকার একটি ছবি টুইটারে শেয়ার করেছেন। ছবিতে দেখা যায়, ইরানের প্রধান মহাকাশ কেন্দ্রের রকেট উৎক্ষেপণ স্থলটির আশপাশ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। বড় ধরনের কোনো বিস্ফোরণের পর কোনো স্থাপনার যে অবস্থা হয় ঠিক সেরকম। এ ধরনের ছবি সাধারণত অত্যন্ত গোপনীয় হয়। এ ছাড়া মানের দিক থেকে ছবিটি সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবির মতোই। বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
ছবিটি শেয়ার করে ইরানকে খোঁচা মেরে ট্রাম্প লেখেন, ‘ইরানে সেমনান লঞ্চ সাইট ওয়ানে সাফির এসএলভি উৎক্ষেপণের সর্বশেষ প্রস্তুতি নেওয়ার সময় যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হাত নেই।’
ট্রাম্প আরো লেখেন, ‘আশা করছি, সাইট ওয়ানে কী ঘটেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারবে ইরান। শুভ কামনা রইল।’
The United States of America was not involved in the catastrophic accident during final launch preparations for the Safir SLV Launch at Semnan Launch Site One in Iran. I wish Iran best wishes and good luck in determining what happened at Site One. pic.twitter.com/z0iDj2L0Y3
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) August 30, 2019
ট্রাম্পের এমন টুইটের পর বেশ কয়েকটি প্রশ্ন সামনে উঠে এসেছে। এটা কি ট্রাম্পের স্বভাবগত ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য নাকি ভুল তথ্য উপস্থাপন? ট্রাম্প কি তাহলে বলতে চাইছেন অন্য কেউ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত? নাকি ট্রাম্প যেমন সবসময় হুটহাট কোনো কিছু নিয়ে মন্তব্য করে ফেলেন, এটাও তেমনই একটি টুইট?
এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে বরাবরের মতোই ট্রাম্প কিছু বললে সেখান থেকে উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেয়ে প্রশ্নই ওঠে বেশি।
বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে আসছিলেন যে, ইরান একটি মহাকাশ কেন্দ্রে রকেট উৎক্ষেপণ নিয়ে কাজ করছে।
স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ওই মহাকাশ কেন্দ্রের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, উৎক্ষেপণ স্থল নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
ইরানি গণমাধ্যমের সূত্র মতে, পৃথিবীর কক্ষপথে ‘নাহিদ-১’ নামের একটি ছোট টেলিযোগাযোগ উপগ্রহ পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান।
এ বছর আরো দুবার উপগ্রহটি পাঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল দেশটি। তৃতীয়বারের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে বলে ট্রাম্পের টুইট করা ছবি দেখে মনে হচ্ছে। তবে এবারের বিষয়টি একটা জায়গায় ভিন্ন। ইরানের মহাকাশ কেন্দ্রের উৎক্ষেপণ স্থলটি (লঞ্চপ্যাড) ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটা নিজ দায়িত্বে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এখন প্রশ্ন হলো লঞ্চপ্যাডে কীভাবে এমনভাবে বিস্ফোরিত হলো ইরানের রকেট? এর ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত জানা নেই। তবে দুটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়—প্রথমত, সাধারণ কোনো কারিগরি ত্রুটি যেমন জ্বালানি-সংক্রান্ত কোনো ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। কিংবা রকেটের নির্মাণের সময় থেকে যাওয়া কোনো ত্রুটি থেকে এমনটা হতে পারে।
রকেট বা উপগ্রহ উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রেরও এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়, প্রযুক্তির দিক থেকে উন্নত প্রায় সব দেশেরই এমন অভিজ্ঞতা আছে। তবে এ ধরনের উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে ইরানের সাফল্যের হার তুলনামূলক বেশ কম।
গত ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ওই নিবন্ধে বলা হয়, ইরান এ বছর আরো যে দুবার উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল, সেগুলো একটি নির্দিষ্ট ধরনের ভুলের অংশ।
এ ছাড়া ওই নিবন্ধে আরো বলা হয়, গত ১১ বছরে ইরানের উপগ্রহ উৎক্ষেপণ চেষ্টার ৬৭ শতাংশই অসফল।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যদি ইরানের তুলনা করা হয়, তাহলে এ ধরনের উৎক্ষেপণ চেষ্টায় দেশটির ব্যর্থতার হার অন্যদের চেয়ে অনেকটাই বেশি বলে নিউইয়র্ক টাইমসের ওই নিবন্ধে বলা হয়। এ ধরনের উৎক্ষেপণে অন্যান্য দেশের ব্যর্থতার গড় হার পাঁচ শতাংশ।
এ ছাড়া ওই নিবন্ধে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ইরানের মিসাইল তৈরির কার্যক্রম ভণ্ডুল করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বলা হয়, উপগ্রহ নির্মাণের জন্য সরবরাহকৃত প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ ঢুকিয়ে দেওয়াসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন।
তাহলে কি ইরানের মহাকাশ কেন্দ্রের সর্বশেষ দুর্ঘটনার সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের কোনো সংযোগ রয়েছে? এর উত্তর আপাতত না মিললেও একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার। ইরানের মহাকাশ কেন্দ্রে বিস্ফোরণের ছবি টুইট করে ব্যাপারটি বেশ ঘোলাটে করে ফেলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইরানের সামরিক গবেষণায় বহি:শক্তির হস্তক্ষেপের অপচেষ্টার ইতিহাস বেশ পুরোনো। এর আগে কম্পিউটার ভাইরাস ব্যবহার করে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা করেছিল ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। হত্যা করা হয়েছিল ইরানি বিজ্ঞানী ও টেকনিশিয়ানদের।
ইরানের মহাকাশ প্রকল্পের সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি কার্যক্রম ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে দাবি করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানি মহাকাশ কেন্দ্রের যে ছবি টুইট করেছেন, এ ধরনের ছবি সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত স্যাটেলাইট ছাড়া অন্য কোথাও বা কারো কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।
আর তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইট করা ছবি দেখে নড়েচড়ে বসেছে মিসাইল ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কাজ করা টুইটারভিত্তিক গ্রুপগুলো।
গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে অন্যদের চেয়ে কতটা এগিয়ে আছে, ওয়াশিংটনের শত্রুদের জন্য তার একটি বড় উদাহরণ ট্রাম্পের টুইট, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।