ভারতে অভিনব চাঁদাবাজির শিকার বাংলাদেশিরা
বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাতায়াতের সময় পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার সীমান্ত শহর বনগাঁয় হয়রানির শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সম্প্রতি এমন অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী। বাংলাদেশের বেনাপোল পেরিয়ে ভারতের পেট্রাপোল সীমান্ত পার হওয়ার পর বিভিন্নভাবে তাদের হয়রানি করে টাকা আদায় করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
পুলিশ বলছে, এ ধরনের কোনো অভিযোগ তাঁদের কাছে আসেনি। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিভিন্ন হুমকিতে প্রাণের ভয়ে পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ জানাতে পারেননি তাঁরা। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় পুলিশের একটি অংশও গোপনে এই অপকর্মে জড়িত।
চাঁদাবাজি ছাড়াও নানা প্রয়োজনে ভারতে আসা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে অভিনব উপায়ে টাকা আদায় করছেন কিছু অসাধু কর্মচারী। সরেজমিন পরিদর্শনে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ স্টেশন চত্বর এবং পেট্রাপোল থেকেই মূলত বাংলাদেশিরা এক ধরনের অসাধু চক্রের নজরবন্দি হয়ে যান।
ভুক্তভোগী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশি যাত্রীরা অটোতে উঠতে গেলে কিংবা অটো থেকে নামতে গেলেই একদল যুবক এসে হাজির হয় তাঁদের সামনে। এরপর স্থানীয় ক্লাব কিংবা সংগঠনের নাম করে দেশের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তাঁদের রীতিমতো জেরা করা হয়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের ব্যাগ তল্লাশি করা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
এই ধরনের ভুয়া তল্লাশি যে কেবল বনগাঁ স্টেশনেই হয় তা কিন্তু নয়। মাঝরাস্তায় অটো দাঁড় করিয়েও চলে যাত্রীদের জেরা এবং তল্লাশি। বনগাঁ থেকে পেট্রাপোল পুরো পথটুকুই এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশি যাত্রীদের জন্য আতঙ্কের।
ভুক্তভোগীদের কয়েকজন জানান, সাধারণত বাংলাদেশি যাত্রীদের কাছে থাকা বৈধ পাসপোর্টে দুটো রুট দিয়ে যাতায়াতের অনুমতি থাকে। সে ক্ষেত্রে সরাসরি ঢাকা থেকে গন্তব্যে ভ্রমণে স্থলপথের সঙ্গে রেলপথ অথবা বিমানপথের উল্লেখ থাকে ভিসায়। কিন্তু অনেকেই ভ্রমণের খরচ বাঁচানোর জন্য একটু ভেঙে যান। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অভিনব পন্থায় চলে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের কারসাজি।
বেশ কয়েকজন যুবক বাংলাদেশি যাত্রীদের ঘিরে ধরে প্রশ্ন করে, ভিসায় দুটো রুটের কথা উল্লেখ থাকতে এই পথে কেন আসছেন আপনারা? প্রাথমিকভাবে এই ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়ে যাত্রীদের উত্তর হয়, যাতায়াতের সুবিধা কিংবা ভ্রমণ খরচ বাঁচানোর জন্য এই পথে আসা।
এরপরেই অসাধু চক্র ভিনদেশে আসা ওই যাত্রীকে চূড়ান্ত হেনস্তা করে পুলিশ কিংবা রেল পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে তুলে দেওয়ার ভয়ও দেখানো হয়। এরপর পরিকল্পনামতো নিরীহ বাংলাদেশি যাত্রীদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তোলে, চোরাই মাল পাচার করার সুবিধার জন্যই কি এই বিকল্প রুটে যাতায়াত করছেন আপনারা?
পুলিশের পরিচয়ে আসা যুবকদের এই ধরনের প্রশ্নের মুখে স্বভাবতই অসহায় বোধ করতে থাকেন ভিনদেশে আসা বাংলাদেশিরা। এরপর ওই যাত্রীদের কাছে টাকা চাওয়া হয়। কালেভদ্রে কেউ এর প্রতিবাদ করতে গেলে নেওয়া হয় নতুন পন্থা। অভিযোগ আছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বনগাঁ থানার পুলিশের ভয়ও দেখানো হয়। এরপর পরিকল্পনামতো কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যও হাজির হন ঘটনাস্থলে। এরপর ওই পুলিশ সদস্যরাও বিভিন্ন প্রশ্ন করে জেলে পুরে দেওয়ার ভয় দেখান।
আর তখন এই হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কার্যত অসহায় বোধ করেন বাংলাদেশি যাত্রীরা। এরপরে ঝামেলা থেকে মুক্তি দেওয়ার নাম করে ওই যাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই টাকার পরিমাণ পাঁচ থেকে ১০ হাজার রুপিতেও পৌঁছে যায় বলে অভিযোগ।
দুর্গাপূজার মুখে এই চক্রটি অনেকটাই বেপরোয়া। পূজার দিন যতই এগিয়ে আসছে, ততই প্রকাশ্যে যশোর রোডের ওপর চাঁদাবাজদের উপদ্রব বাড়ছে বলেও অভিযোগ উঠছে। যশোর রোডের ওপর গাইঘাটার কলাসিম বাজার, ধরমপুর, চাঁদপাড়া থেকে শুরু করে বনগাঁর কালোপুর এলাকাতেও এই চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য বিস্তৃত।
তবে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরুণ হালদার জানালেন, এই ধরনোর কোনো অভিযোগ তাঁর কাছে আসেনি। তিনি এনটিভি অনলাইনকে জানান, ‘চাঁদা তোলা হচ্ছে কিংবা জুলুমবাজি চলছে এমন অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। তবুও কিছুদিন ধরে সাংবাদিকরা বিষয়টি আমাদের অভিহিত করেছেন। তাঁদের কথার ওপর ভিত্তি করেই সীমান্তবর্তী প্রতিটি থানাকে এই বিষয়ে কড়া নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস জানান, ‘বনগাঁয় এই ধরনের কোনো ঘটনার কথা আমার জানা নেই। তবে বিক্ষিপ্তভাবে কখনো এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিষয়টির প্রতি আমরা কড়া নজর রাখছি।’
অন্যদিকে চাঁদাবাজিতে এবং ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যাত্রী যাতায়াত ও পণ্যবাহী ট্রাকের ক্ষেত্রে যাতে কোনো রকম সমস্যার সৃষ্টি না হয় তার জন্য প্রশাসনকে সতর্ক থাকার নির্দেশ জারি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। এনটিভি অনলাইনের কাছে তিনি বলেন, ‘দুই দেশের বন্ধুত্ব এবং সম্প্রীতি যাতে কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রয়েছে আমাদের। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলেই পুলিশকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেওয়া রয়েছে।’