পাকিস্তান জাতীয় নির্বাচনের ভেতর-বাহির
পাকিস্তানের ১১তম সাধারণ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলছে। দেশটির ইতিহাসে এ নির্বাচন নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। জাতীয় এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অভ্যুত্থান ঘটবে বলে অনেকের আশাবাদ।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের ৭১ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশটি সেনা শাসনের আওতায় চলেছে। গত ৭১ বছরের ইতিহাসে কেবল দ্বিতীয়বারের মতো পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের নির্বাচিত কোনো সরকারের মেয়াদকাল শেষে সামরিক শাসনের শিকার না হয়ে পুনরায় জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুযোগ পেয়েছেন।
আলোচিত এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রধান তিনটি দল হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল), নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।
তিনটি দলই প্রভাববিস্তারী হলেও জরিপকারী সংস্থাগুলোর মতে, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এ নির্বাচনে পিএমএল ও পিটিআইর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
পিএমএলের নেতা ৬৮ বছর বয়সী নওয়াজ শরিফ কারাগার থেকে এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে নওয়াজ ও তাঁর মেয়ে মরিয়ম কারাগারে আছেন।
নির্বাচনের কয়েক দিন আগে নওয়াজ তাঁর মেয়ে মরিয়মকে নিয়ে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর পরই গ্রেপ্তার হন। তারপর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। নির্বাচনী কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগে আদালতে এ ব্যাপারে কোনো আবেদনের শুনানি হবে না।
নওয়াজ শরিফের হয়ে বর্তমানে তাঁর ভাই পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
পিটিআই হলো এ নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত দল। ইমরান খানের নেতৃত্বে থাকা দলটিকে ঘিরে অনেকে পাকিস্তানের দ্বি-দলীয় রাজনীতির বাইরে একটি নতুন আশা দেখতে পাচ্ছেন। দলের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করা ইমরান গত সপ্তাহে বিবিসিকে বলেন, তাঁর বিরোধীরা নির্বাচনে হেরে যাবে ক্ষমতায় থাকাকালীন যার যার কৃতকর্মের কারণেই।
এ দুই দলের বাইরে আছে পাকিস্তানের নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর দল পিপিপি। বর্তমানে বেনজিরের ছেলে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্নাতক বিলওয়াল ভুট্টো দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নির্বাচনকে ঘিরে জনগণকে শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক এক পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি জানিয়ে আসছে দলটি।
যে দলই সরকার গঠন করুক, তার হাতেই এসে পড়বে আগামীর পাকিস্তানকে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সফল ও গ্রহণযোগ্য এক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুদায়িত্ব। পারমাণবিক শক্তিধর এ রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা দূর করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ককে নতুন করে রূপ দেওয়ার ব্যাপারেও সে সরকারকে নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ।
এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পর উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিও সামলাতে হবে নির্বাচিত নতুন সরকারকে।
এদিকে গণতন্ত্রের অভ্যুত্থানের আশাবাদ থাকলেও চলমান নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেনা হস্তক্ষেপের আশঙ্কা খুব ভালো ভাবেই বিরাজমান, চলছে নানা বিতর্ক।
নওয়াজ শরিফের পিএমএল এরই মাঝে অভিযোগ করেছে যে, সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে হওয়া এ নির্বাচনে ইমরান খান ও তাঁর পার্টি পিটিআই সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট। যদিও ইমরান খান ও দেশটির সেনাবাহিনী এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কিন্তু এ অভিযোগের পক্ষে উচ্চ আদালতের এক বিচারক বলেছেন, সেনাবাহিনীর শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) আদালতের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করছে।
পিএমএলের অনেক প্রার্থীকে দল ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে বলে জানা গেছে। নির্বাচনী আইন ভঙ্গের দায়ে এযাবৎ দলটির প্রায় ১৭ হাজার কর্মীর নামে দেওয়া হয়েছে ফৌজদারি মামলা। প্রার্থীদের মুখ বন্ধ রাখার ব্যাপারে হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলে অনেকে সমালোচনা করছেন। এর ভেতরেই নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে বিভিন্ন জঙ্গি হামলায় প্রায় দুইশ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
সবকিছুর ভিত্তিতে মানবাধিকার কমিশন চলমান এ ভোট গ্রহণের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাদের সংশয় এমন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করার মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষিত আর কার্যকরী গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারবে কি পাকিস্তান?
আজ স্থানীয় সময় সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়েছে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠান।
৮৫ হাজার ৩০৭টি ভোটকেন্দ্রে একযোগে ভোট দিচ্ছেন দেশটির মানুষ। এরই মধ্যে লাহোর মডেল টাউনের একটি কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ বা পিএমএল-এনের প্রধান শেহবাজ শরিফ।
কেন্দ্রে ভোটারদের সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ২৫ জুলাই সরকারি ছুটি ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার। এবারের নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা ১০ কোটি ৬০ লাখ। নির্বিঘ্নে ভোট গ্রহণ পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে সব ভোটকেন্দ্রে তিন লাখ ৭০ হাজারের বেশি সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
ভোট গ্রহণ চলবে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এরপর শুরু হবে ভোট গণনা। সন্ধ্যা ৭টার আগে গণমাধ্যমগুলোকে অনানুষ্ঠানিক ফল প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়েছে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন।