জীবন-সায়াহ্নে মনসুর, আজগরের ইচ্ছাপূরণ
বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের পোয়াকাঠি ছিটমহলের মনসুর আলী মিঞা (১০২) আর ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল মশালডাঙ্গার আজগর আলী (১০৬) দুজনেই দুই দেশের ছিটের বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা। স্বাধীনতার অনেক বছর পেরিয়ে দুজনের মনেই আজ নতুন করে ‘স্বাধীনতার আনন্দ’।
দুই বৃদ্ধই জানান, জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল দুই দেশের সীমান্তে টানাপড়েনের বাইরে এসে একটি মুক্ত স্বাধীন জীবনের। জীবন-সায়াহ্নে এসে পূরণ হচ্ছে তা।
আজ শুক্রবার (৩১ জুলাই) রাত ১২টা ১ মিনিটের পর মুছে যাচ্ছে ছিটমহলের সব বেড়া। থাকছে না আর কোনো ছিটমহল।
পোয়াকাঠি ছিটমহলের বাসিন্দা মনসুর আলী এ প্রতিবেদককে জানান, এর আগে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার স্বাদ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় নিজভূমেও যেন ছিলেন পরবাসী। আত্মীয়স্বজন, এমনকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতেও লাগত বিএসএফের অনুমতি। আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে নিজের খেয়াল-খুশিমতো স্বাধীনভাবে চলতে পারবেন, এই খুশিতেই উচ্ছ্বসিত তিনি।
আজ শুক্রবার আরো একবার নিজেদের বাসভূমির স্বাধীনতার স্বাদ পেতে ছিটমহলবাসীর সঙ্গে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে অংশ নেবেন তাঁরা।
এদিকে মশালডাঙ্গার আজগর আলী জানান, আজকের দিনটিসহ তিনি মোট তিনবার স্বাধীনতার স্বাদ পাবেন। সাতচল্লিশে পাকিস্তান, একাত্তরে বাংলাদেশ আর দুই হাজার পনেরোতে ছিটমুক্ত বাংলাদেশে।
সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী মোট ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় করবে দুই দেশ। এই ছিটমহলগুলোর ৫০ হাজারের ওপর বাসিন্দা এত দিন শুধু দুই দেশের নাগরিকত্ব থেকেই বঞ্চিত হননি, বঞ্চিত ছিলেন সব রকমের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকেও। আজ মধ্যরাত থেকে অবসান ঘটবে তাঁদের সেই অভিশপ্ত জীবনের। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল আজ মধ্যরাতেই যুক্ত হয়ে যাবে বাংলাদেশের সঙ্গে। এখানকার ৩৭ হাজারের ওপর মানুষ নাগরিকত্ব পাবেন বাংলাদেশের। আর ভারতের ভূখণ্ডে থাকা বাংলাদেশের ৫৫টি ছিটমহল আজ মধ্যরাতে যুক্ত হবে ভারতের সঙ্গে। সেখানকার ১৪ হাজার ২৮৪ বাসিন্দা নাগরিকত্ব পাবেন ভারতের। তবে সর্বশেষ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির জনগণনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে থাকা ভারতের ছিটমহল থেকে ৯৮০ জন মানুষ ফিরে আসবেন ভারতে।
কোচবিহারের জেলা প্রশাসক পি উলগনাথন জানিয়েছেন, এই মানুষগুলোর এত দিন কোনো ঠিকানা ছিল না। এখন তাঁদের ঠিকানা করে দেওয়াই হবে প্রশাসনের অন্যতম কাজ। স্বাভাবিকভাবেই কোনো দেশে দীর্ঘকাল বসবাসের ফলে সবাই সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। বাড়ি তৈরি করেন, জমি কিনে বসবাসের ব্যবস্থা করেও ফেলেছেন। ফলে সহজে কেউই অন্য দেশে আসতে বা যেতে চান না। তবে যাঁরা দেশে ফিরছেন, তাঁরা নিতান্তই হতদরিদ্র বলে জানিয়েছেন উলগনাথন।
এদিকে, ছিটমহলের বুকে ‘নতুন স্বাধীনতা’ ঘিরে তুমুল ব্যস্ততা। প্রতিটি ছিটের কোনায় কোনায় চলছে ছোট, বড়, মাঝারি মাপের নানা অনুষ্ঠানের কর্মসূচি। আজকের দিনটি ছিটমহলবাসী তাঁদের জীবনে স্বাধীনতার সূর্যোদয় বলে মনে করছেন। রাত পোহালেই ১ আগস্ট। এদিন ভারতের অভ্যন্তরে ৫৫টি ছিটমহলের বাসিন্দাদের দেশটির নাগরিকত্ব পাওয়ায় সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের আকস্মিক মৃত্যুতে সাত দিনের জাতীয় শোক চলছে দেশজুড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাসিন্দারা ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছে জেলা প্রশাসন। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি কালামের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে পতাকা উত্তোলন করে পরে তা অর্ধনমিত রাখা হবে। কিন্তু সেটা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
কোচবিহারের জেলা প্রশাসক পি উলগনাথন বলেন, ‘এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি আমরা।’
ভারতের কোচবিহারের তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছিল মশালডাঙ্গা। সরেজমিনে দেখা গেছে, ৬৮ বছরের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে সেখানকার বাসিন্দারা এখন বাঁধনহারা। আজ শুক্রবার সকাল থেকেই এলাকার বিভিন্ন মসজিদে যেমন চলছে বিশেষ প্রার্থনা, তেমনি মন্দিরেও পূজার মাধ্যমে পালিত হচ্ছে মুক্তির উৎসব।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি জানিয়েছে, শুক্রবার রাতে মশালডাঙ্গায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সে অনুষ্ঠানকে ঘিরে সকাল থেকে মাতোয়ারা ছিটের বাসিন্দারা। এরই মধ্যে অবশ্য এর তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। মশালডাঙ্গায় প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের বাস হলেও এরই মধ্যে পাশের বিভিন্ন ছিটমহল থেকে দলে দলে মানুষ সেখানে আসতে শুরু করেছেন। কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত জানান, অনুষ্ঠানে প্রশাসনিক কর্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে ছিট আন্দোলন নিয়ে কমিটির নানা কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হবে।
এদিন সন্ধ্যা থেকেই প্রদীপের আলো আর মোমবাতির শিখায় যেমন ছিটমহল উদ্ভাসিত হওয়ার অপেক্ষায় এখন প্রহর গুনছে, তেমনি রাতের আকাশে হাওয়াইয়ের রংমশাল আর সুরেলা মিউজিকের তালে তালে মাতোয়ারা হতে আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার অপেক্ষায় ছিটমহলবাসী।