সু চি কেন রোহিঙ্গাদের রক্ষা করছেন না?
মানতাবাদী হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাওয়া, শান্তিতে নোবেলজয়ী ও গণতন্ত্রের প্রতিমূর্তি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া একজন মূলত বার্মা চালান । অং সান সু চি, যিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা, ভোগ করেছেন দীর্ঘ গৃহবন্দিত্ব, সহ্য করেছেন দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা নির্যাতন, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবেননি কিংবা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আশাও ছাড়েননি।
এত কিছুর পরও গত বছর তাঁর দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটির কার্যত নেতা (যদিও আনুষ্ঠানিক প্রেসিডেন্ট নন) সু চি নীরবে লাখ লাখ রোহিঙ্গার (১০ লাখের বেশি জনসংখ্যার মুসলিম সংখ্যালঘু) হত্যা ও পালিয়ে যাওয়া দেখেছেন।
২০১৬ সালে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে বর্বরোচিত নির্যাতন শুরু করে বার্মার সেনাবাহিনী। এর পর পুলিশ পোস্টে রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বিক্ষিপ্ত হামলা জেনারেলদের আরো ক্ষিপ্ত করে তোলে। তাদের সঙ্গে স্বঘোষিত কিছু রক্ষক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যোগ দেয়। এই গ্রীষ্মে ওই তৎপরতা আরো বেড়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অন্য পর্যবেক্ষকরা শহর থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন, সম্পূর্ণ গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযান ও বার্মার (যেটি মিয়ানমার নামেও পরিচিত) সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা হত্যার বিবরণ দিয়েছে। শুধু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতেই জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তিন লাখ ৭০ হাজারের মতো (সর্বশেষ হিসাবে ৪ লক্ষাধিক) রোহিঙ্গা।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান রাখাইনের অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূলের পরিষ্কার উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এনপিআর (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রেডিও)-এর ভাষ্য, ‘মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে নির্বিচার হত্যা ও অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও নির্যাতন হয়েছে, যা ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সহিংসতার চিত্র।’
সু চি, যার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিও দীর্ঘ সামরিক শাসনের সময় দমনপীড়ন ও বর্বরতার শিকার হয়েছে, নির্মোহভাবে এই সংকটের দিকে নজর দিতে চাচ্ছেন না। এখন পর্যন্ত সহিংসতার কেন্দ্রস্থলে যাননি সু চি এবং জনসমক্ষে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি সশস্ত্র বাহিনীর সমালোচনা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। চলতি মাসে তিনি দাবি করেন, রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে ‘তুষারস্তূপের মতো ভুল তথ্য’ ছড়ানো হচ্ছে। তাঁর দপ্তর রোহিঙ্গাদের করুণ অবস্থার ওপর কথিত ‘ভুয়া সংবাদ’ নিয়ে বিদ্রূপ করেছে। তাঁর মুখপাত্র মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারকে বলেন, রোহিঙ্গারা ‘তরবারি, ছোরা, গুলতি ও নিজেদের তৈরি বন্দুক নিয়ে তৈরি আছে’ এবং এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দৃশ্যত বিপদ মনে হলেই রোহিঙ্গাদের ওপর অরোহিঙ্গাদের গুলির সুযোগ করে দিয়েছে।
একজন মানুষ যিনি এত ভালো কিছু অর্জন করেছেন, তিনি কেমন করে এমন কদর্যতায় জড়ালেন? এর পেছনে সম্ভাব্য আন্তসম্পর্কিত বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
প্রথমত, সু চির বর্তমান নীরবতা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কয়েক বছর ধরে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ : তিনি কখনোই খুব বেশি সমব্যাথী ছিলেন না। ২০১৫ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের আগে প্রচারণায় তিনি রাখাইনে সহিংসতা নিয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছেন। যদিও এর আগের ধাপেও রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বিপন্ন হয়েছে এবং তখন পর্যন্ত কোনো জঙ্গি সংগঠন দাঁড়ায়নি। ভোটের কিছুদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সাংবাদিকদের রোহিঙ্গাদের সমস্যার বিষয়টি ‘অতিরঞ্জিত’ না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এই অনাগ্রহ হয়তো সু চির ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা অসম্ভব। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখা পিটার পপহ্যাম নামের একজন জীবনীকার লিখেছেন, সু চি প্রকৃতপক্ষে গোঁড়া নন : তাঁর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টাদের মধ্যে মুসলিম ছিল (যদিও তাঁরা রোহিঙ্গা নন)। পপহ্যাম বলেন, তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাড়িত করা অন্যতম ব্যক্তি হলেন সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের একজন মুসলিম লেখক মং থো কা।
তবে সু চি তাঁর দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৫ সালে এবং ২০১৭ সালের বর্তমান সময় পর্যন্ত এনএলডির সাধারণ সদস্যদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়ে কোনো উদ্বেগ ছিল না। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বৌদ্ধর মতো অনেক এনএলডি সদস্য মনে করেন, রোহিঙ্গারা বহিরাগত ‘বাঙালি’। তারা এ দেশে (মিয়ানমার) বসবাস করতে পারে না। যদিও তাদের কেউ কেউ কয়েক প্রজন্ম ধরে দেশটিতে আছে।
গত বছর বার্মায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীটিকে রোহিঙ্গা না বলতে সু চি আহ্বান জানিয়েছিলেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এটা তাদের (রোহিঙ্গা) দেখার ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির একটা নমুনা। এর মানে দাঁড়ায়, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা নেই।
সু চি এমনটাও মনে করতে পারেন, রাখাইনে বর্বরোচিত সামরিক অভিযান বন্ধে তাঁর সামর্থ্য খুবই কম। তিনি সরকারের কার্যত প্রধান হলেও শীর্ষ জেনারেল মিন অং হ্লেইং বহু ক্ষমতার অধিকারী। বার্মার সংবিধান সশস্ত্র বাহিনীকে সামরিক বাজেট ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত মন্ত্রণালয়গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দিয়েছে। এ ছাড়া পার্লামেন্টে তাদের জন্য ২৫ শতাংশ আসনও বরাদ্দ আছে। সম্ভবত, ভবিষ্যতে বেসামরিক শাসনের একটা পর্যায়ে গিয়ে রাজনীতিতে ভূমিকা কমে আসার পর সেনাদের ক্ষমতা কমবে। সে পর্যন্ত দলীয় লোকজনের কাছে উপেক্ষিত একটি বিষয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাচারণ করে রাজনৈতিক শক্তি খরচ করাকে অবাস্তব মনে করতে পারেন সু চি।