সৌদি না কাতার : অগ্নিপরীক্ষায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের সঙ্গে আরব বিশ্বে মার্কিন মিত্রদের কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টি সবারই জানা। গেল সোমবার সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ ‘অস্থিতিশীলতা’ সৃষ্টির অভিযোগে কাতারের সঙ্গে পররাষ্ট্র সম্পর্কের পাট চুকিয়ে ফেলে।
জবাবে ওই দেশগুলোর সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয় কাতারও। এরপর বিভিন্ন দেশ নিজ নিজ কৌশল অনুযায়ী সমর্থন দেয় এ দুই পক্ষকে। ভৌগোলিক দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশের দূরুত্ব অনেক হলেও এ দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দেশ দুটির বড় প্রভাব রয়েছে। তাই এই সংকটের সময় বাংলাদেশ কাকে সমর্থন করবে, সেটাও দেখার বিষয়।
সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ইতিহাসটা বেশ পুরোনো। বাংলাদেশ থেকে সৌদিতে রপ্তানি করা জনশক্তির পরিমাণটাও নেহাত কম নয়। আর কাতারেও অবস্থান করছে বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক। তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকটাই চাঙ্গা রেখেছে। তাই দুই পক্ষের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো রাখাটা জরুরি। এ জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার খেলায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের যে ভালোই মাথা ঘামাতে হবে, তা বোঝা যায়।
সম্পর্ক বিচ্ছিন্নের ক্ষেত্রে কাতারের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসবাদের সমর্থন করা। সৌদিসহ সম্পর্কচ্ছেদকারী দেশগুলোর দাবি, কাতার যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সমর্থন করছে, তাদের অনেককেই নাকি পরিচালনা করে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী সৌদি আরবের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে গেলে একমাত্র ইরান।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘আরব ইসলামিক আমেরিকান সামিট’-এ ইরানের বিপক্ষে বেশ কড়া সুরে কথা বলেন মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। সে সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। আর এই যোগদান যে সৌদি তথা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমবাজারসহ ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ফল বয়ে আনবে, তা ভালো করেই জানত বাংলাদেশ।
অন্যদিকে আরব বিশ্বের ছোট দেশগুলোর অন্যতম কাতারকেও কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারবে না বাংলাদেশ। প্রচুর বাংলাদেশির রুটি-রুজির জোগান দেয় এই ছোট্ট দেশটিই। কাতারে কাজ করছে অন্তত চার লাখ বাংলাদেশি।
কাতারে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ২০২২ সালে বিশ্বকাপ উপলক্ষে চলছে ব্যাপক নির্মাণকাজ। সেখানে শ্রম দিতে গেল বছরেই বাংলাদেশ থেকে গেছে অনেক নির্মাণ শ্রমিক। বর্তমান সংকটে সৌদির পক্ষে অবস্থান নিলে বিশাল এই জনশক্তির ওপর খারাপ প্রভাব আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কাতার এর মধ্যেই সেখানে কর্মরত সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সম্পর্কচ্ছেদকারী দেশগুলোর নাগরিকদের চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। আর জানিয়েও দিয়েছে, সম্পর্কচ্ছেদকারী দেশের বন্ধুদের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করবে তারা।
অন্যদিকে সৌদির নেতৃত্বে থাকা মার্কিন মিত্রজোটও এ বিষয়ে কঠোর। আমিরাত, সৌদিসহ অন্যান্য দেশ জানিয়ে দিয়েছে, কাতারের মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না তারা।
সম্প্রতি সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। জোটটি ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহী দমনে দেশটিতে সরকারের পক্ষে হামলা চালায়। ওই হামলার সমর্থন দেয় বাংলাদেশও। এদিকে কাতার ইয়েমেনে চালানো সৌদি জোটের হামলার বিরোধিতা করে। এরই জের ধরে কাতারের বিরুদ্ধে হুথি যোদ্ধাদের সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়।
এ বিষয়ে ‘বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টটিউটে’র ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির জানান, এই পরিস্থিতি যদি আরো জটিল হয়, তাহলে বাংলাদেশের জন্য কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কারণ এরই মধ্যে সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। তাই সেখান থেকে কাতারের বিপক্ষে দাঁড়ানোর চাপ আসতে পারে বাংলাদেশের ওপরে।
বাংলাদেশের ‘ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে’র গবেষক নাজনীন আহমেদ জানিয়েছেন, বিষয়টি হয়তো এখনই বাংলাদেশের অর্থনীতি কোনো প্রভাব ফেলবে না। তাও অনেক বিচক্ষণতার সঙ্গে বাংলাদেশকে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সৌদি আরবের সঙ্গে বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গেলেও সৌদির মন জুগিয়ে চলতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশে সৌদির বড় প্রভাব রয়েছে, তাই কাতারের বিপক্ষে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ আসতে পারে। আর কাতারেও রয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি করা জনশক্তির বড় একটি অংশ। তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে মন রেখে চলতে হবে কাতারেরও। এই উভয়-সংকট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে সামাল দেন, সেটিও দেখার বিষয়।