মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘে রেজল্যুশন গৃহীত
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে সদস্য দেশগুলোর উপস্থিতিতে উন্মুক্ত ভোটের মাধ্যমে আবারও রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে বিপুল ভোটে একটি রেজল্যুশন গৃহীত হয়েছে। রেজল্যুশনটির পক্ষে ১৪০টি দেশ ও বিপক্ষে ৯টি দেশ ভোট দেয়। এ ছাড়া কোনো পক্ষেই ভোট দেয়নি ৩২টি দেশ। বার্তা সংস্থা ইউএনবি এ খবর জানিয়েছে।
রেজল্যুশনটি গৃহীত হওয়ার পর এ বিষয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে স্থানীয় সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শিরোনামে আনীত এবারের রেজল্যুশনটির বিশেষ দিক হলো, এতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন উপায়গুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রেজল্যুশনটি নিরাপত্তা পরিষদকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যা নিরাপত্তা পরিষদের ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যর্থতার জন্য এতে মিয়ানমারকে দায়ী করে স্পষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রদর্শন ও প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ তৈরিসহ সুনির্দিষ্ট ১০টি বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এতে মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতকে বাস্তব পরিস্থিতির বিষয়ে রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যেসব প্রস্তাবনা দেন, তার বেশ কয়েকটি রেজল্যুশনটিতে স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি ‘রোহিঙ্গা মুসলিম’ শব্দটি রেজল্যুশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন তাঁর বক্তব্যে রেজল্যুশনটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এটি সমর্থন করতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এটিকে আমরা শুধু একটি দেশভিত্তিক রেজল্যুশন হিসেবেই দেখছি না, এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি দায়বদ্ধতার দলিল, যার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন।’
তিনি এ সমস্যার সমাধানে দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার বিশেষ গুরুত্বের কথাও তুলে ধরেন।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে বিবেচনাধীন পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন ও গণহত্যা বলে অভিহিত এই সহিংস অপরাধের প্রকৃত দোষীদের দায় নিরূপণের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করতে ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এবারের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ‘মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন’, ‘রাখাইন প্রদেশে বেসামরিক তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় প্রতিষ্ঠা’ ও ‘প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ ও আস্থা তৈরি করা’সহ যেসব প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন, তা তুলে ধরেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এসব প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি।
তৃতীয় কমিটিতে গৃহীত রেজল্যুশনটি আগামী ডিসেম্বরে সাধারণ পরিষদের প্লেনারিতে উপস্থাপিত হবে। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষে রেজল্যুশনটি এবার উপস্থাপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ফিনল্যান্ড।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন শুরু থেকেই এই রেজল্যুশনটি প্রক্রিয়াকরণ, উপস্থাপন ও গ্রহণের ক্ষেত্রে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
২০১৭ সালের উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর ওই বছর থেকেই নিয়মিতভাবে ওআইসির নেতৃত্বে মিয়ানমারের মানবাধিকার সংকট ইস্যুতে তৃতীয় কমিটিতে এই রেজল্যুশন আনা হচ্ছে। গত বছর থেকে ওআইসি ও ইইউ যৌথভাবে তৃতীয় কমিটিতে রেজল্যুশনটি উত্থাপন করছে এবং প্রতিবারই বিপুল ভোটে তা গৃহীত হচ্ছে। এবারের রেজল্যুশনটি মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপকে শুধু জোরদারই করবে না, বরং তা অব্যাহত রাখতে ভূমিকা রাখবে বলে জানানো হয়।
ওআইসি ও ইইউর সদস্যরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, মেক্সিকোসহ মোট ১০২টি দেশ রেজল্যুশনটির পৃষ্ঠপোষণ এবং বিপুল ভোটাধিক্যে রেজল্যুশনটি গৃহীত হয়, যা রোহিঙ্গা বিষয়ে বিশ্ব জনমতের জোরালো প্রতিফলন।
রেজল্যুশনটি ভোটে যাওয়ার আগে এর পক্ষে ভোট দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বক্তব্য দেন ফিনল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, সৌদি আরব ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধিরা। ভোট গ্রহণের আগে ও পরে দেওয়া বক্তব্যে প্রায় সব সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সংরক্ষণ, টেকসই পুনর্বাসন, জাতিগত নিধন ও গণহত্যার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ, সহিংসতার দায় নিরূপণ ও অপধারীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানসহ মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রেজল্যুশনটি তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে গৃহীত বৈশ্বিক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ বলেও মন্তব্য করেন প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া এই রেজুলেশন সংকটটির সমাধানে অন্যান্য অংশীজনদের উৎসাহিত করবে এবং যেসব দেশ এখনো এতে নেতিবাচক ভোট দিচ্ছে, তাদের নৈতিক চাপের মধ্যে ফেলবে বলেও মন্তব্য করেন কূটনীতিকরা। তাঁরা সবাই বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান ও অব্যাহতভাবে মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের ভূয়সী প্রশংসা করেন।