মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন : কে এগিয়ে—ট্রাম্প না বাইডেন?
যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা আগামী ৩ নভেম্বর নির্ধারণ করবেন তাঁরা বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আরো চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসে দেখতে চান কি না। নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন।
জো বাইডেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনেক বেশি পরিচিত, যদিও তিনি গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন।
নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, জনমত যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পছন্দ-অপছন্দ জানতে ততই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ভোটারদের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, তারা কোন প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে আগ্রহী।
জাতীয়ভাবে প্রার্থীরা কে কেমন করছেন?
জনপ্রিয়তার দৌড়ে কোন প্রার্থী কতটা এগিয়ে আছেন, সে বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে পরিচালিত জরিপ বা সমীক্ষা থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তবে এসব জরিপ থেকে নির্বাচনের ফল সম্পর্কে আগে থেকে আন্দাজ করা কঠিন।
উদাহরণ হিসেবে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই নির্বাচনের আগে জাতীয় পর্যায়ে পরিচালিত জনমত জরিপে এগিয়ে ছিলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে তিনি ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিলারি হেরে যান এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ নির্বাচনী ব্যবস্থা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির কারণে এ রকম হয়েছে। তাই বেশি ভোট পেলেই কেউ নির্বাচনে জয়ী হবেন, সেটা সব সময় নিশ্চিত করে বলা যায় না।
এ বছর জাতীয় পর্যায়ে যত জরিপ হয়েছে, তার বেশির ভাগ ফলাফলেই জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন।
গত কয়েক সপ্তাহে যেসব জরিপ হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বাইডেনের প্রতি সমর্থন ৫০ শতাংশের কাছাকছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন ১০ পয়েন্টে। তবে ট্রাম্প গত কয়েক দিনে এই দূরত্ব কিছুটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
গত ৪ আগস্টের জরিপে দেখা যাচ্ছে, জো বাইডেনের প্রতি সমর্থন যেখানে ৪৯ শতাংশ, সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন ৪৫ শতাংশ।
গত নির্বাচনের আগে হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে কার অবস্থান কোথায়, সে চিত্রটি ততটা পরিষ্কার ছিল না।
এবার দুই প্রার্থী জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেশি। কোথাও কোথাও ৫ থেকে ১০ শতাংশ। অথচ ২০১৬ সালের জনমত জরিপগুলোতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও হিলারি ক্লিনটনের মধ্যে ব্যবধান ছিল সামান্য কিছু পয়েন্ট।
ফলাফল নির্ভর করবে কোন কোন অঙ্গরাজ্যের ওপর?
গত নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনের পরাজয় থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, কোন প্রার্থী কত বেশি ভোট পেয়েছেন, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোন রাজ্যে কোন প্রার্থী বেশি ভোট পেয়েছেন।
সাধারণত বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যেই সব সময় একই রকমের ভোট পড়ে। কিছু কিছু রাজ্য আছে, যেখানে দুজন প্রার্থীর যে কেউ বিজয়ী হতে পারেন। এসব অঙ্গরাজ্যেই নির্ধারিত হবে, কে নির্বাচনে জয়ী আর কে পরাজিত হবেন। জয়-পরাজয়ের যুদ্ধটা হয় সেখানেই আর তাই এসব অঙ্গরাজ্যকে বলা হয় ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেটস’।
ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের হাতে থাকে কিছু ভোট। কোন রাজ্যের কত ভোট, সেটা নির্ভর করে ওই রাজ্যের জনসংখ্যার ওপর। সবচেয়ে বেশি ভোট টেক্সাস রাজ্যের—৩৮টি।
ইলেকটোরাল কলেজে মোট ভোট ৫৩৮। কোনো প্রার্থীকে বিজয়ী হতে হলে তাঁকে ২৭০টি ভোট পেতে হবে।
তাই প্রতিটি নির্বাচনের সময় দেখা গেছে, যেসব রাজ্যের ভোট বেশি, প্রার্থীরা সেসব রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারণার পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করে থাকেন।
বর্তমান জরিপের ফলাফল জো বাইডেনের পক্ষে। কিন্তু নির্বাচনের এখনো অনেকটা সময় বাকি। যেকোনো সময় এই ফলাফল দ্রুত বদলে যেতে পারে।
জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, জো বাইডেন মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে এগিয়ে আছেন। এ তিনটি শিল্প এলাকা। এসব অঙ্গরাজ্যে ২০১৬ সালের নির্বাচনে বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী ১ শতাংশেরও কম ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন।
এখনকার জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব অঙ্গরাজ্যে এগিয়ে আছেন, সেগুলো হচ্ছে—জর্জিয়া, আইওয়া ও টেক্সাস। তবে ব্যবধান খুব সামান্য।
গত নির্বাচনেও এসব রাজ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ভোটের ব্যবধান ছিল আরো অনেক বেশি।
জো বাইডেন এগিয়ে আছেন যেসব রাজ্যে : অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, মিশিগান, মিনেসোটা, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, পেনসিলভানিয়া, ভার্জিনিয়া ও উইসকনসিন।
জো বাইডেনের জন্য ভালো খবর হচ্ছে, এসব অঙ্গরাজ্যে তিনি বড় ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালের নির্বাচনে এসব অঙ্গরাজ্যের বেশির ভাগেই ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এসব অঙ্গরাজ্যে এখন এগিয়ে গেছেন জো বাইডেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য এখন এটাই দুশ্চিন্তার কারণ।
২০১৬ সালের নির্বাচনে আইওয়া, ওহাইও ও টেক্সাসে ট্রাম্প ৮ থেকে ১০ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু এখন জো বাইডেনের সঙ্গে তাঁর অবস্থান প্রায় সমানে সমান।
এসব পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন গত জুলাই মাসে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার দলের ম্যানেজার বদলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ ছাড়া ট্রাম্প এসব জনমত জরিপকে প্রায়ই ‘ভুয়া’ বলে উল্লেখ করে থাকেন।
জুয়াড়ি সংস্থাগুলো অবশ্য এখনই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বাতিল করে দিচ্ছে না। কেউ কেউ বলছে, ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা এখনো এক-তৃতীয়াংশ।
করোনাভাইরাসের কারণে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমেছে?
এ বছরের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম দখল করে আছে নভেল করোনাভাইরাস। মহামারির পরিস্থিতি মোকাবিলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভূমিকা নিয়ে তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে কথা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেসব ব্যবস্থা নিয়েছেন, সেগুলোর পক্ষে সমর্থন তুঙ্গে ওঠে গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে। তখন ট্রাম্প সারা যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে অঙ্গরাজ্যগুলোর জন্য ঘোষণা করেছিলেন পাঁচ হাজার কোটি ডলার।
শীর্ষস্থানীয় একটি জরিপ প্রতিষ্ঠান ইপসসের হিসাব অনুসারে, সে সময় ৫৫ শতাংশ মার্কিনি ট্রাম্পের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল।
ডেমোক্র্যাট দলের যাঁরা তাঁকে সমর্থন দিয়েছিলেন, পরে তাঁরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখে। তবে বেশির ভাগ মানুষই বর্তমানে ট্রাম্পের গৃহীত পদক্ষেপের সমালোচনা করছে।
সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরাও এখন তাঁর নেওয়া পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যগুলোর পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তারা সমালোচনায় সরব হয়েছে। গত জুলাই মাসের শুরুতে ট্রাম্পের প্রতি রিপাবলিকানদের সমর্থন কমে ৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
অনেকেই বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো এ কারণে করোনাভাইরাস সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য পরিবর্তন করছেন।
শুরুতে ট্রাম্প বলেছিলেন, করোনাভাইরাস একসময় ‘আপনাআপনি চলে যাবে’, কিন্তু এখন তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ‘পরিস্থিতি ভালো হওয়ার আগে মহামারি আরো খারাপ রূপ’ নিতে পারে।
শুধু তাই নয়, এর আগে ট্রাম্প মাস্ক পরার সমালোচনা করতেন, কিন্তু এখন তিনি নিজেই মাস্ক পরছেন। এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের প্রতি মাস্ক পরার আহ্বান জানিয়ে ‘দেশপ্রেমের’ পরিচয় দেওয়ার কথা বলছেন ট্রাম্প।
এদিকে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মডেল অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের মাত্র দুদিন আগে, অর্থাৎ ১ নভেম্বরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
এসব জরিপ কি বিশ্বাসযোগ্য?
আগের নির্বাচনের জনমত জরিপ ভুল প্রমাণ হয়েছিল—এটা বলে খুব সহজেই এসব সমীক্ষা বাতিল করে দেওয়া যেতেই পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও প্রায়ই এ কাজটা করে থাকেন। কিন্তু এটা পুরোপুরি সত্য নয়।
গত নির্বাচনে বেশির ভাগ জাতীয় জরিপে হিলারি ক্লিনটনকে সামান্য পয়েন্টে এগিয়ে রাখা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তারা ভুল করেছে। কারণ, হিলারি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছিলেন।
আগের নির্বাচনের জনমত জরিপগুলোতে কিছু সমস্যা ছিল। সেসব জরিপ ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির গুরুত্ব তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এবার তাদের সেই ত্রুটি কাটিয়ে উঠেছে।
কিন্তু তারপরও এবারের পরিস্থিতি আরো কঠিন, আরো অনিশ্চিত। এর কারণ নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং নভেম্বরে মানুষের ভোটের ওপর করোনাজনিত মহামারি কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। কেননা, নির্বাচনের এখনো আরো কয়েক মাস বাকি।