ন্যাটো : মার্কিন নেতৃত্বের সামরিক জোট কি এখনো প্রয়োজন?
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন’, যার সংক্ষিপ্ত নাম ‘ন্যাটো’। স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর দিকে এ ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গঠনের উদ্দেশ্য ছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সমন্বিত সুরক্ষা দেওয়া।
সত্তর বছর পর বিশ্বে এসেছে অনেক পরিবর্তন। বর্তমান বিশ্বে অগ্রাধিকার পাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা। এমন একটি বিশ্বে ন্যাটো জোট কি এখনো প্রাসঙ্গিক? সম্প্রতি ন্যাটোর ভেতরকার পরিস্থিতিও আর আগের মতো নেই। সংস্থাটি কিংবা এর সদস্যভুক্ত দেশগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসির বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ইউএনবি এ খবর জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ২৯ রাষ্ট্রের ন্যাটো জোট গতকাল মঙ্গলবার ও আজ বুধবার লন্ডনে বৈঠকে বসেছে। যদিও জোটের সদস্যরা ন্যাটোকে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে সফল সামরিক জোট হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন, তবুও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কীভাবে গঠিত হয়েছিল ন্যাটো?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইউরোপের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মিলে গঠন করে ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ন্যাটো। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিরোধ করা।
যুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপজুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল পরিমাণ সেনা রয়ে যায়। পূর্ব জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশের ওপর আধিপত্য পায় মস্কো।
যুদ্ধের পর জার্মানির রাজধানী বার্লিন দখলে নেয় বিজয়ীরা। ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্ট্যালিন পশ্চিম বার্লিনের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু করেন। সে সময় ওই এলাকা ছিল তৎকালীন মিত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে।
১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও আরো ১১টি দেশ (যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, আইসল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ) মিলে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গঠন করে। ১৯৫২ সালে তুরস্ক ও গ্রিসকে সদস্য করার মাধ্যমে জোটটির কলেবর বৃদ্ধি পায়। এর পর ১৯৫৫ সালে জোটে যুক্ত হয় পশ্চিম জার্মানি।
১৯৯৯ সাল থেকে সাবেক পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্রগুলোকেও সদস্য করে ন্যাটো। এতে জোটভুক্ত মোট দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯টি। সবশেষ ২০১৭ সালে ন্যাটো সদস্য হয় মন্টেনেগ্রো।
ন্যাটোর উদ্দেশ্য কী?
দাপ্তরিকভাবে ন্যাটো গঠনের উদ্দেশ্য ‘উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও কল্যাণ’ নিশ্চিত করে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ‘স্বাধীনতা, অভিন্ন ঐতিহ্য ও সভ্যতার’ রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা।
চুক্তি অনুযায়ী, ন্যাটোভুক্ত যেকোনো দেশের ওপর সশস্ত্র হামলা হলে সেটি জোটভুক্ত সব দেশের ওপর হামলা বলেই গণ্য হবে এবং সব দেশ একে অন্যের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। বাস্তবে জোট নিশ্চিত করে, ‘ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা অবিচ্ছেদ্যভাবে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত।’
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সাম্যবাদকে ন্যাটো তাদের বড় হুমকি মনে করত। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে ন্যাটোর সীমান্ত মস্কোর দিকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে।
এ ছাড়া ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে জোটটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে নিজেদের সদস্য হিসেবেই গণ্য করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত, তাহলে ন্যাটো টিকে আছে কেন?
স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই—তার মানে এই নয় যে পশ্চিমারা মস্কোকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করে দেবে।
২০০৩ সালে এক ভাষণে ন্যাটোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেমি শেয়া বলেন, ‘কেউই হঠাৎ করে বিশ্বাস করেনি যে কমিউনিজমের (সমাজতন্ত্র) অনুপস্থিতি একটি দুশ্চিন্তামুক্ত পরিস্থিতি ও একটি স্বর্ণযুগের সূচনা করেছে, যেখানে মিত্রশক্তির কোনো ধরনের সশস্ত্র বাহিনী প্রয়োজন হবে না কিংবা তারা সুরক্ষা ছাড়াই বসবাস করতে পারবে।’
বাস্তবে রাশিয়া সামরিকভাবে শক্তিশালী রয়ে যায়। আর যুগোস্লাভিয়ার পতনের পর ১৯৯০ সালে খোদ ইউরোপেই যুদ্ধ দেখা দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে ন্যাটোর ভূমিকা পরিবর্তিত হয়ে এটি হস্তক্ষেপকারী জোটে পরিণত হয়েছে। যার উদাহরণ মেলে বসনিয়া ও কসোভোয় সার্বিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিমান হামলা, নৌপথে প্রতিরোধ ও শান্তিরক্ষা বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে।
২০০১ সালে ন্যাটো প্রথমবারের মতো ইউরোপের বাইরে তাদের অভিযান চালায়। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পর আফগানিস্তানে জাতিসংঘের নির্দেশনায় যৌথ বাহিনীর কৌশলগত নেতৃত্ব নেয় ন্যাটো।
আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতার উদ্দেশ্যে এখনো দেশটিতে ন্যাটোর নেতৃত্বে ১৭ হাজার সেনা রয়েছে।