আসছে ভিটামিন সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস

Looks like you've blocked notifications!

ভাত বাংলাদশের মানুষের প্রধান খাদ্য। তাই তো বলা হয় ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। বাঙালির ভাত না খাওয়া পর্যন্ত পেট ভরে না, খিদে মেটে না। কিন্তু খাদ্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মানুষের সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন পরীমিত ও সুষম খাদ্য গ্রহণ। সেজন্য খাদ্য তালিকাতে প্রতিদিনই ভাত মাছের পাশাপাশি শাকসবজি, ডাল, দুধ, ফলমূল ইত্যাদি পরিমাণ মতো থাকা প্রয়োজন। তাহলেই সেটি হবে সুষম খাদ্য।

আমাদের দেশে সব পর্যায়ের মানুষের খাদ্য গ্রহণে পুষ্টি সচেতনতা থাকে না। তা ছাড়া সুষম খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে ধারণাও অনেকের নেই। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই গ্রামে বাস করে। সেসব মানুষের ধারণা ও সঙ্গতি দুটোরই অভাব। আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাতের সাথে সুষম পরিমাণ অন্যান্য খাদ্য গ্রহণের সক্ষমতা নেই। তাই তারা সারাবছর শুধু ভাতকেই খাদ্য মনে করে। আর্থিক অনটনের কারণে তারা ভাত খেয়েই খিদে নিবারণ করে থাকে।

তাই এখানে কৃষি বিজ্ঞানীদের একটি দায় রয়েছে। সে দায়টি হলো দেশের মানুষকে খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি পুষ্টি চাহিদা মেটানো। কৃষি বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশকে ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনের আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধিতে প্রথম, আলু উৎপাদনে অষ্টম, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, ফল উৎপাদনে ২৮তম, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং ফসলের জাত উদ্ভাবনে প্রথম স্থানে অধিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। সেই হিসেবেই বাঙালির প্রধান খাদ্য ধানের জন্য প্রায় ৮০টির বেশি জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর সব জাতই উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের আরেক গর্বের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। এর সাথে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) এরও অবদান রয়েছে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশে যে ধানের জাতগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে এবার আসছে ‘গোল্ডেন রাইস’ নামে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধানের জাত । যে জাতটি ব্রি এবং ইরি উভয় প্রতিষ্ঠানের যৌথ সহযোগিতায় জেনেটিক্যালি (জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে) উদ্ভাবন করা হয়েছে। সোনালি রঙের এ ধানের মধ্যে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ জিন। আর এখানেই কৃষি বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। আর সেটি হলো সুষম খাবারের সাথে যেমন ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। তা শরীরের অল্প পরিমাণ প্রয়োজন হলেও তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা জানি বিশেষ বিশেষ ভিটামিনের অভাবে শরীরে বিশেষ বিশেষ রোগ দেখা দেয় যা সেই ভিটামিনের দ্বারাই পূরণ হওয়া সম্ভব।

একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, গোল্ডেন রাইসের জাতটি কোনো হাইব্রিড ধানের জাত নয়। কোনো ফসলের জাত যদি হাইব্রিড হয় তাহলে সেই জাতের বীজ রাখা কৃষক পর্যায়ে সম্ভব হয় না। কারণ হাইব্রিড জাতের বীজ রাখার জন্য কৃষকের যে উচ্চ প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকা দরকার তা না থাকায় সেটি উৎপাদন ও সংরক্ষণ করা কঠিন। সেজন্য হাইব্রিড বীজ সবসময়ই আমদানি করতে হয় অথবা কোনো কোম্পানিকে উৎপাদন করতে হয়। কিন্তু গোল্ডেন রাইস ইনব্রিড হওয়ায় তা সহজেই কৃষক পর্যায়ে অন্যান্য স্বাভাবিক সব বীজের মতোই তা উৎপাদন ও সংরক্ষণ করা যাবে। অপরদিকে স্বভাবিক ধানের মধ্যে বিশেষ জেনেটিক পদ্ধতিতে ভিটামিন-এ ও বিটা ক্যারোটিনের জিন সংযোজন করায় এতে পরিবেশ এবং মানবদেহে এর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না, তাও পরীক্ষা করা হয়েছে। উক্ত পরীক্ষ-নিরীক্ষার পর ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে পরিবেশ ছাড় পাওয়া গেছে। এখন সব ডকুমেন্টসহ বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষে আগামী ২-৩ মাসের মধ্যেই সেই ছাড়পত্র পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইরি এবং ব্রির যৌথ একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি নবনিযুক্ত কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের সাথে সাক্ষাতের পর এমনটাই গণমাধ্যমে জানিয়েছেন তিনি।

যদি বাংলাদেশে প্রকৃতভাবেই গোল্ডেন রাইস উৎপাদনের জন্য অবমুক্ত করে দেওয়া হয় তবে তা কৃষিতে আরেকটি যুগান্তকারী অর্জন হবে। বাংলাদেশের মাটি, জল ও অবহাওয়ায় চাষকৃত অন্যান্য ধানের মতোই এটি আবাদ হবে এবং অন্যন্য ধানের জাতের সমপরিমাণ ফলনও হবে। মাঝে থেকে বাড়তি পাওনা হবে ভিটামিন। বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের মানুষ বিশেষ করে নিম্ন আয়ের যারা পুষ্টিকর খাবার কিনে খেতে পারে না তাদের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এখন পুষ্টির দিক থেকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে গোল্ডেন রাইস। কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে মাঠে নিয়ে আসা প্রয়োজন এবং কৃষক পর্যায়ে তা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাহলেই এর সুফল পেতে থাকবে জনগণ।  

লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়