ছাত্রলীগের নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাবিতে বিক্ষোভ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চারজনকে মারধরের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ঘটনাস্থলে গতকাল বুধবার থেকেই অবস্থান নিয়েছেন ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার মো. মুকিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে আমার নিরাপত্তা নেই। হলে যাব কীভাবে?’
আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাবির ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ মানববন্ধনের আয়োজন করেন। পরে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও মানববন্ধনে যোগ দেন। এতে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। এ সময় মারধরে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান তাঁরা।
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘কিছুদিন আগেই বুয়েটে আবরার একইভাবে মারধরের শিকার হয়েছেন। এখন আমাদের একজন সহপাঠী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং হামলাকারীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। এই ক্যাম্পাসে আর কোনো সন্ত্রাসের ঠাঁই হবে না।’
শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, ‘শিক্ষকদের উপস্থিতিতে তাঁদের মারধর করা হয়েছে। ওই শিক্ষকদেরও বিচার হওয়া উচিত। কেউ শিবির করলে তার জন্য প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে, তারা কীভাবে মারে? এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এদিকে মানববন্ধনে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘সন্ত্রাসের কালো হাত ভেঙে দাও’, ‘ভিসি, প্রক্টর, প্রভোস্ট করে কী, খায়-দায় ঘুমায় নাকি?’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ইত্যাদি।
এদিকে নির্যাতনের শিকার ঢাবির ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. মুকিম চৌধুরী গতকাল বুধবার বিকেল থেকেই রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নিয়েছেন। শাহবাগ থানা থেকে ছাড়া পেয়ে গতকাল বিকেল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেন তিনি। ভুক্তভোগী এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, এর বিচারের দাবিতে এখানে বসেছি। কিছু বানোয়াট স্ক্রিনশট দিয়ে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।’
এদিকে ওই শিক্ষার্থীকে হলে ফিরিয়ে নিতে গতকাল রাতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। এ সময় মুকিম প্রশ্ন করেন, ‘পুলিশ কেন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল? কেন হলে নিল না?’ তিনি আরো বলেন, ‘ক্যাম্পাসে আমার নিরাপত্তা নেই, হলে যাব কীভাবে?’
এ সময় হল প্রভোস্ট ড. দেলোয়ার হোসেন ওই ছাত্রকে হলে অথবা বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে কোনো ধরনের সমস্যা হলে দায়-দায়িত্ব আমি নেব। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ যদিও সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত হলে ফিরতে অস্বীকৃতি জানান মুকিম চৌধুরী।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ঢাবির শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে শিবির সন্দেহে চার শিক্ষার্থীকে মারধরের এ ঘটনা ঘটে। পরে ছাত্রলীগের নেতারা শিবির সন্দেহে পুলিশে দিলেও কোনো প্রমাণ না পেয়ে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ।
এ ঘটনায় আহতরা হলেন ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. মুকিম চৌধুরী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সানওয়ার হোসেন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজ উদ্দীন ও একই বর্ষের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী আফসার উদ্দিন। এর মধ্যে গুরুতর আহত হওয়ায় মুকিম ও সানওয়ারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সহসভাপতি আনোয়ার হোসাইন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজা শিবির সন্দেহে মুকিমকে গেস্টরুমে নিয়ে যান। পরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কথাবার্তায় হামজার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। পরে তাঁরা মুকিমের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় আফসারকেও গেস্টরুমে নিয়ে যান। এরপর তাঁদের দুজনকে হলের বর্ধিত ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। উভয়ের সঙ্গে সানওয়ার, মিনহাজের মেসেঞ্জারে যোগাযোগ থাকায় তাঁদেরও ডাকা হয়।
ভুক্তভোগীদের বর্ণনামতে, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তাঁদের জহুরুল হক হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্ত ও হল শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন আলম চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। এ সময় লাঠি, রড দিয়ে পিটিয়ে এবং কিল-ঘুষি মারেন হলের সাবেক সহসভাপতি কামাল উদ্দিন রানা ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘রাত ১১টার দিকে মুকিমকে রুমে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে বন্ধুরা দিবাগত রাত ১টার দিকে তাঁকে খুঁজতে বের হলে গেস্টরুম থেকে বড় ভাইদের মুকিমকে সঙ্গে নিয়ে বের হতে দেখি। এ সময় মুকিম আহত অবস্থায় ছিল।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘আনোয়ার হোসাইন তাদের ডেকে আনলেও মারধরে জড়িত ছিলেন না।’
এদিকে মারধর শেষে হলের আবাসিক শিক্ষক বিল্লাল আহমেদের মাধ্যমে প্রক্টর টিম ও পুলিশের হাতে দেওয়া হয়। পরে পুলিশ আহত অবস্থায় তাঁদের শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়।
এদিকে ঘটনার বিষয়ে জহুরুল হক হল সংসদের সহসভাপতি সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্ত, সহসভাপতি আনোয়ার হোসাইন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজা দাবি করেন, ‘চারজন যে শিবির করে, তার প্রমাণ তাঁরা পেয়েছিলেন। তা ছাড়া তাদের থেকে দুটি শিবির সংশ্লিষ্ট বইও উদ্ধার করেছি। যা পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে।’
যদিও মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁদের কথা হলে তাঁরা কোনো বইয়ের নাম বলতে পারেননি। পরে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের বিরুদ্ধে শিবিরের কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পুলিশকে বলে দেওয়া হয়েছে যে, কোনো প্রমাণ না পেলে তাঁদের থানায় না রাখতে। নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা হলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে যদি কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করে, তবে আমরাও বিষয়টি দেখব।’
আনোয়ার হোসেন ও আমির হামজা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয়ের অনুসারী। এ বিষয়ে জয় বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি তাদের মারধর করা হয়নি। তবে যদি কেউ মারধর করে, তবে এটা সমর্থনযোগ্য নয়।’