কুবিতে তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে হেনস্তার অভিযোগ শিক্ষার্থীর

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষিকার বিরুদ্ধে নিজের বলে থিসিস চালিয়ে দেওয়ার অভিযোগে তৈরি হওয়া তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে মানসিক হেনস্তার অভিযোগ করেছেন রিফাত সুলতানা। গতকাল বুধবার (৩০ এপ্রিল) রাতে কুবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী বরাবর ই-মেইলে এ অভিযোগ জানান তিনি।
এর আগে কুবির ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইসরাত জাহান নিমনীর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীর গবেষণাপত্র নিজের বলে প্রকাশ করার অভিযোগ করেছিলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিফাত সুলতানা। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কুবিতে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। গত ২২ এপ্রিল তদন্তের জন্য রিফাত সুলতানাকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকা হয়। তখনি মানসিক হেনস্তা করা হয় বলে অভিযোগ করেন এই শিক্ষার্থী।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন—কুবির কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. বনানী বিশ্বাস, রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান।
ইমেইলে পাঠানো অভিযোগ পত্রে রিফাত সুলতানা উল্লেখ করেন, গত ২২ এপ্রিল তদন্ত কমিটি সাক্ষাতের জন্য আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকেন। শিক্ষিকার বিরুদ্ধে আমার দেওয়া অভিযোগের তদন্ত না করে পক্ষপাত মূলক আচরণ এবং অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে মানসিক চাপ দিয়ে অভিযোগ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এবং কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. বনানী বিশ্বাসের মতে, সুপারভাইজার একক লেখক হিসেবে আর্টিকেল প্রকাশ করতে পারেন। থিসিসকারী ছাত্রের অনুমতি না নিয়ে প্রকাশ করাকে তারা অন্যায় বলে মনে করেন না। কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. বনানী বিশ্বাসের মতে, সুপারভাইজার যদি থিসিসকারী ছাত্রের বিনা অনুমতি নিয়ে গবেষণা আর্টিকেল প্রকাশ করেন, তাহলেও সেটা চৌর্যবৃত্তি বলে গণ্য হবে না।
অভিযোগ পত্রে আরও বলা হয়, কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. বনানী বিশ্বাস তার অভিযোগ পত্র থেকে ‘কনসেন্ট’ বা অনুমতি শব্দটি তুলে নেওয়ার জন্য বারবার চাপ প্রয়োগ করেন। অভিযোগকারী অসম্মতি জানালে বনানী বিশ্বাস তাকে ‘অভিজ্ঞতা কম’ বলে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন। রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এবং কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. বনানী বিশ্বাস রিফাত সুলতানার এ ধরনের অভিযোগকে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি বলে উল্লেখ করেন।
অভিযোগ পত্রে আরও বলা হয়, রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের মতে রিফাত সুলতানার গবেষণা পত্র থেকে সহকারী অধ্যাপক ইসরাত জাহান নিমনী একটি অংশ ব্যবহার করেছেন। সম্পূর্ণ অংশ নয়। তিনি এটাকে গুরুতর অপরাধ মনে করেন না। এ ছাড়া কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান বিচারের জন্য থানায় অভিযোগ করতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন অভিযোগ দিয়েছি একারণে রিফাত সুলতানাকে ভর্ৎসনা করেন।
রিফাত সুলতানা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রথমবার অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে ২২ এপ্রিল তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকা হয়। তদন্তের সময় তারা পক্ষপাত মূলক আচরণ করেন। মানসিক চাপ দেয় যেন আমি অভিযোগ তুলে নিই।’ তিনি আরও বলেন, আমি আমার মেধাসত্ত্বের স্বীকৃতির জন্য বিচার চেয়েছি। আমার আর্টিকেল থেকে কিছু অংশ সরাসরি ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু অংশ আংশিক ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যে তিনি (ইসরাত জাহান নিমনী) এগুলো ব্যবহার করবে না তার নিশ্চয়তা চাই।
কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো কিছু বলব না। তদন্ত কমিটির মুখপাত্র ও সেক্রেটারি আছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলেন। আমি তো তদন্ত কমিটির সদস্য মাত্র।’
কুবির রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘একটা আর্টিকেলে সুপারভাইজার ও ছাত্রের দুইজনের নাম আছে। তাহলে এটা কীভাবে চুরি হয়। এই প্রশ্ন করলে যদি উনি বিব্রত হন, তাহলে এরপর তো এটা আমাদের আমলে নেওয়ার কিছু নাই। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, একটা আর্টিকেলে ছাত্র শিক্ষক দুজনের নামই আছে। এখন অনুমতি নিয়েছে কি-না, এ বিষয়ে আমরা কী করতে পারি। তারপরও একটা সমাধানের জন্য তাকে ডাকা হয়েছে। তাকে প্রশ্ন করলে যদি মানসিক হেনস্তা হয়, তাহলে তো তদন্ত কমিটির দরকার নেই। তিনি মামলা করে বিষয়টি কোর্টে ফয়সালা করতে পারেন।’
কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, ‘তার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। তদন্ত কমিটির কাজ হচ্ছে প্রশ্ন করে তথ্যগুলো আদায় করে নেওয়া। আমাদের সদস্যদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি এমন কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন সেগুলো আদালতের বিবেচনার বিষয়, তদন্ত কমিটির কাজ না। আমাদের কাজ হচ্ছে কী ঘটেছে খুঁজে বের করা। তদন্ত কমিটির কাজ তো কাউকে শাস্তি দেওয়া না। সেই প্রসঙ্গে বলেছি আপনার যদি আরও রেমিডির প্রয়োজন হয় তাহলে আপনি আদালতের শরণাপন্ন হন। সেখানে হয়তো আপনি বিচার পেতে পারেন।’
কুবির উপাচার্য ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী বলেন, ইমেইলে অভিযোগটি এখনও পাইনি। রোববার অফিসে গিয়ে মেইলটি চেক করবো। অভিযোগটি দেখার পর বিষয়টি বলতে পারব।
আগের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য বলেন, ‘ছাত্র আর শিক্ষকের সম্পর্ক এমন হওয়ার কথা না। অনেকদিন কাজ করার ফলে সুপারভাইজার ও থিসিস ছাত্রের সুন্দর একটা সম্পর্ক হয়। একজন শিক্ষককে চোর বলাটা দুঃখজনক।’
অভিযোগকারী রিফাত সুলতানা নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। ২০১৯ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন ইসরাত জাহান নিমনী। ওই সময়ে শিক্ষার্থী রিফাত সুলতানার থিসিসের সুপারভাইজার ছিলেন তিনি। তার অধীনে রিফাত সুলতানা একটি থিসিস করেন, যার শিরোনাম ‘সাবজুগেশন, মার্জিনালাইজেশন অ্যান্ড ডাবল কলোনাইজেশন : অ্যা রিডিং অব দ্য অবরোধবাসিনী, দ্য ডার্ক হোল্ডস নো টেররস অ্যান্ড দ্য গড অব স্মল থিংস’। ওই থিসিসের বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে গত ৩১ ডিসেম্বর ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইংলিশ লিটারেচার অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস’ জার্নালে ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স : আ কোয়েস্ট ফর সেলফ ইন শশী দেশপান্ডে’স দ্য ডার্ক হোল্ডস নো টেররস’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন ইসরাত জাহান। এই নিবন্ধে রিফাত সুলতানাকে দ্বিতীয় লেখক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
রিফাত সুলতানা অভিযোগ করেন, ইসরাত জাহান নিমনী তার অনুমতি ছাড়া এমএ থিসিসের ৩ নম্বর অধ্যায় থেকে সরাসরি অনুলিপি করেছেন। গত ১৩ মার্চ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর অভিযোগ পাঠান রিফাত সুলতানা। যার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।