হাকিম চত্বরের ভিন্ন রকম গল্প

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়—এটি এদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থান যেমন টিএসসি, বটতলা, মলচত্বর, রাজু ভাস্কর্য—তেমনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো ‘হাকিম চত্বর’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এক আবেগময় নাম ‘হাকিম ভাই’। অনেকের স্মৃতিতেই এই নামটি জড়িয়ে আছে চিরন্তন এক মুগ্ধতায়। ক্যাম্পাস জীবনের নানা গল্প, স্মৃতি আর আবেগের সঙ্গে মিশে থাকা এই নামটি মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আশির-নব্বই দশকের প্রাণবন্ত আড্ডা, আন্দোলন, চায়ের কাপ হাতে আলোচনা কিংবা চুপচাপ বসে থাকা কিছু মুহূর্তের চিত্র।
‘হাকিম ভাই’ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একজন চা বিক্রেতা। সহজ-সরল এই মানুষটি চায়ের দোকানের পাশাপাশি হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষার্থীরে এক আত্মীয়সুলভ আশ্রয়। তার ছোট্ট দোকানটি ছিল আড্ডার আঁতুড়ঘর। সকাল-বিকেল তার দোকানে ভিড় লেগেই থাকত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অভিনেতা সবাই-ই কমবেশি তার চায়ের ভক্ত ছিলেন। আর এ কারণেই হাকিম ভাইয়ের চায়ের দোকানে সবসময় ভিড় জমেই থাকতো। তবে ভিড়টা বড় বেশি হতো সকাল এবং সন্ধ্যাবেলাতে। অসংখ্য শিক্ষার্থী হাকিম ভাইয়ের চা পান করতে করতে নানা আলোচনায় মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন। সেই আলোচনায় রাজনীতি, সাহিত্য, নাটক, গল্প, প্রেম-ভালবাসা কোনো কিছুই বাদ যেত না। আবার অভিমানী অনেক তরুণ-তরুণীর কাছেও এক আস্থার মানুষ ছিলেন হাকিম ভাই। এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে শেষ খবরটি নিতেন হাকিম ভাইয়ের কাছ থেকেই। অনেক প্রেমিক-প্রেমিকাই হাকিম ভাইয়ের কাছে চিঠি, গিফট পর্যন্ত রেখে যেতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশদ্বারের ডান পাশে ছিল ‘হাকিম ভাই’-এর চায়ের দোকান। সাদামাটা এই দোকানে বসার তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও ইটের উপর কয়েকটা তক্তার ওপর গড়ে উঠত শিক্ষার্থীদের ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধনের আবহ। অনেক প্রেমিক-প্রেমিকাও তার কাছে রেখে যেতেন চিঠি কিংবা উপহার। সেগুলো তিনি সংরক্ষণ করতেন নিঃস্বার্থভাবে।
হাকিম ভাই ছিলেন নির্ভরতার প্রতীক। রাজনৈতিক কর্মী, রোকেয়া হলের ছাত্রী, তরুণ কবি কিংবা শিক্ষক—সবার কাছেই তিনি ছিলেন এক বিশ্বাসযোগ্য নাম। তিনি জানতেন কে, কোথায় চায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন, কখনও বিরক্ত হতেন না। তার দোকান হয়ে উঠেছিল অনেক গোপন যোগাযোগের মাধ্যম, কখনো বা রাজনৈতিক কর্মসূচির সূতিকাগার।
সত্তর দশকের শেষলগ্নে তিনি শুরু করেছিলেন চায়ের দোকান। কিন্তু আশি ও নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসক এরশাদের আমলে তার দোকানটি হয়ে ওঠে ছাত্রদের প্রগতিশীল আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। জাসদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে এটি ছিল আড্ডা ও আন্দোলনের পরিকল্পনার মূল জায়গা।
২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর হাকিম ভাই আকস্মিকভাবে মারা যান। আগের দিন তিনি গ্রামের বাড়ি দোহারে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি মারা যান। তার জীবদ্দশাতেই এই জায়গাটি ‘হাকিম চত্বর’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তার মৃত্যুর পর এই নাম আরও বেশি স্থায়ী হয়।
তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে হাবিবুর রহমান জিন্নাহ, আকরাম হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় ‘হাকিম ভাই স্মৃতি পরিষদ’। প্রতি বছর এই পরিষদ হাকিম চত্বরে স্মরণসভা আয়োজন করে। আজও পুরনো প্রজন্মের কেউ কেউ হাকিম চত্বরে গিয়ে স্মৃতি হাতড়ান, আবেগে ভাসেন।
‘হাকিম চত্বর’ তাই কেবল একটি জায়গা নয়—এটি এক অনুভব, এক ইতিহাস, এক সংস্কৃতির নিদর্শন। এক চা বিক্রেতার মানবিকতা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা কিভাবে হাজারো শিক্ষার্থীর স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকতে পারে, তারই এক অনন্য উদাহরণ হয়ে রয়েছে হাকিম ভাই বা হাকিম চত্বর।
‘হাকিম ভাই’ এর মৃত্যুর পর তার স্মরণে হাবিবুর রহমান জিন্নাহ, আকরাম হোসেন-এর নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় ‘হাকিম ভাই’ স্মৃতি পরিষদ। প্রতি বছর ‘হাকিম ভাই’ স্মৃতি পরিষদ-এর পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় হাকিম চত্বরে। স্মরণে আনা হয় ‘হাকিম ভাই’কে। ‘হাকিম ভাই’ আজও অমলিন আমাদের হৃদয়ে, অনুভবে।