‘কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উত্তেজনা ছিল’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থিতিশীল ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষকরা ও শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের মতো যৌক্তিক আন্দোলনে শিক্ষকদের পাশে থাকা নৈতিক দায়িত্ব বলেও মনে করেন তাঁরা।
আজ সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এক মতবিনিময় ও আলোচনা সভায় একথা উঠে আসে। ক্যাম্পাসে স্থিতিশীল পরিবেশ ও শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসারপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক, রোবায়েত ফেরদৌস, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক রশিদুল হাসান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে চাকরিচ্যুত অধ্যাপক নাসির উদ্দীন আহমেদ প্রমুখ।
আলোচনায় উঠে আসে যে, ঢাবি ক্যাম্পাসে এখনো শিক্ষার্থীদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংকট সমাধান করতে পারেনি। ক্যাম্পাস স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তাহীনতায় থাকা শিক্ষার্থীরা যাতে সহজে অভিযোগ করতে পারে সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বাসভবনের সামনে অভিযোগ বাক্স চালুর দাবিও জানানো হয়।
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘কোটা আন্দোলনে পুলিশের আক্রমণ করার যৌক্তিকতা ছিল না। এর আগে সমাধান করা সরকারের দায়িত্ব ছিল। এখন মামলা দিয়ে বিষয়টি আরো জটিল করে তুলেছে। উপাচার্যের বাসভবনে হামলা নিন্দনীয়। আমি মনে করি এই হামলা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের পক্ষ থেকে আসেনি।’ সংসদে কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার মধ্যে উত্তেজনা ছিল বলেও মন্তব্য করেন ঢাবির সাবেক এই অধ্যাপক। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটানোর দাবি জানান তিনি।
ক্ষমতাসীন হলে সবাই অসাধারণ হয়ে ওঠে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দূরে সরে যায় বলে মন্তব্য করেন তানজিম উদ্দীন খান। তিনি বলেন, ‘এটা একটা রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু এটা রাজনীতি না সত্যিকার রাজনীতি হলে বঙ্গবন্ধুর মতো দেশের কল্যাণে কাজ করত। যারাই ক্ষমতাই থাকুক তারাই একই কাজ করে। এ রকম পরস্থিতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফরম টিকিয়ে রাখতে হবে। নিরাপত্তা ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। হল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার জন্য উপাচার্যের বাস ভবনের সামনে একটি অভিযোগ বাক্স চালু করতে হবে। সেখানে শিক্ষার্থীরা নামে-বেনামে অভিযোগ দেবে। এক মাস পর তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সামনে উত্থাপন করে অভিযোগগুলোর সুরাহা করতে হবে।’
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘কোটা আন্দোলনকে বিএনপি, শিবিরের কর্তৃক পরিচালিত আন্দোলন মনে করে দমনের চেষ্টা করা হলে সেটি খুবই ভুল করবে। এটিও সত্য যে এই আন্দোলনে শত্রুপক্ষ ঢুকে বিভ্রান্তি তৈরি করে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। যার একটি উদাহরণ ভিসির বাড়িতে আক্রমণ। ভিসিও বলেছে আক্রমণকারীরা বহিরাতগত। যাদেরকেআটক করা হয়েছে তারাও বহিরাগত। উদোর পিণ্ডি বুদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো সাধারণ শিক্ষার্থীর ওপর রাষ্ট্র বা কোনো বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন করা হয় তাহলে আমরা বরদাশত করব না। আমরা বুক ফুলিয়ে ক্যাম্পাসে চলব আমরা শিক্ষক ছাত্র ন্যায়ের পক্ষে।’
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যৌক্তিক উল্লেখ করে এই শিক্ষক বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি মনে করি মু্ক্তিযোদ্ধারা কোটার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেনি। বিশেষ পরিস্থিতিতে বন্দুক থেকে সরিয়ে দেশ সেবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন সেটি ঠিক ছিল। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে, পৌত্রদের জন্য কোটার দরকার নেই। কারণ সে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীও হতে পারে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা অস্বচ্ছল তাদের জন্য কোটা সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। সেটি এক জেনারেশন জন্য হতে পারে। একবার সুযোগ নেওয়ার পর দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া যাবে না। কোটা ১৫ শতাংশের বেশি নয়।’
এ সময় সংস্কার করে প্রতিবন্ধী কোটা এক ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পাঁচ ভাগ ও নারী কোটা ১০ ভাগ করার পক্ষে মত দেন এম এম আকাশ।
অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘কোটা আন্দোলেনে আমাদের মৌন সমর্থন ছিল। কিন্তু ৮ তারিখের ঘটনার পর আমরা দূরে থাকতে পারিনি। কেন প্রশাসনকে অবহিত না করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হবে। আন্দোলনের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের হয়রানি হলে আমরা কঠোর কর্মসূচি দেব। আমরা দেখছি গণরুমে শিক্ষার্থীদের মনোবল, মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয় কিন্তু এসব কাজে আমাদের শিক্ষক যারা প্রশাসনে থাকে তারা যেন দেখেও না দেখার ভান করে।’ সবকিছুকে ষড়যন্ত্র হিসেবে না দেখে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মত বুঝারও পরামার্শ দেন ঢাবির এই অধ্যাপক।
ভাষা বিজ্ঞানের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে পাশে থাকা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আন্দোলনের একটি ধাপ পার হয়েছে। আন্দোলনে যারা নির্যাতিত হয়েছে তাদের বিষয়েও ভাবতে হবে। ক্যাম্পাসে এখনো শিক্ষার্থীদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। যৌক্তিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে কেন শিক্ষার্থীদের আত্মপরিচয়হীনতায় ভুগতে হবে? সবাইকে সাহসী হতে হবে। তোমরা অনায্য কোনো দাবি নিয়ে আন্দোলন করোনি।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংকট সমাধানে কাজ করতে পারেনি অভিযোগ করে এই অধ্যাপক বলেন, এ আন্দোলনের পাশে যারা দাঁড়িয়েছে তাদের ভিন্ন ভাবে দেখা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত চিন্তা করার জায়গা। স্বাধীন মত প্রকাশের মতো জায়গায় কেন এ সংকট হবে? ক্যাম্পাস স্থিতিশীল রাখতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনের এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে হবে। এ সময় তিনি মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানান।
আলোচনা সভায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বক্তব্য দেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূর, রাশেদ খান, ফারুক হাসান। এ সময় তাঁরা শিক্ষার্থীদের হয়রানি না করা, অজ্ঞাতনামা মামলা প্রত্যাহার করা, দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করা, সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রশাসনকে সহায়তা করা ও হলে হলে কোনো ছাত্র সংগঠন দিয়ে যৌক্তিক আন্দোলনকে দমন না করার দাবি জানান।