ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি দেওয়া ছিল পূর্বপরিকল্পিত
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানিতে আইনজীবী শিশির মনির বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ছিল সাজানো। আইন সংশোধন, ট্রাইব্যুনাল গঠন সবই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। বিচারের নামে অবিচার করে জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সবাই সংঘবদ্ধ অন্যায়-অবচারের শিকার হয়েছেন। যা সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার লেখা ব্রোকেন ড্রিম বইয়ে উঠে এসেছে।
আজ বৃহস্পতিবার (৮ মে) সকাল সাড়ে নয়টা থেকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চে আজহারের পক্ষে শুনানি চলাকালে তিনি এসব কথা বলেন। পিনপতন নীরবতা মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে অংশ নেন এটিএম আজহারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনিক আর হক।
এটিএম আজহার প্রসঙ্গে শিশির মনির শুনানিতে বলেন, আরও সময় সময় পেলে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের ফাঁসি কার্যকর করতেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সময় তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অন্যায়ভাবে এটিএম আজহারে ফাঁসি কার্যকর করলে আমরা আদালতের সামনে আসতে পারতাম না। আপনাদের সামনে সুবিচার করার সুযোগ এসেছে।
পরে আদালত থেকে বের হয়ে শিশির মনির বলেন, আপিল বিভাগ যদি এটিএম আজহারকে খালাস দেন তাহলে জুডিসিয়াল কিলিংয়ের যে নমুনা এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই কলঙ্ক থেকে বিচার বিভাগ আংশিক মুক্ত হবে। আমরা মনে করি, জামায়াতে ইসলামী যে নজিরবিহীন নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে সময় পার করেছে এই রায়ে সবার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার হবে।
আজহারের বিষয়ে শিশির মনির আরও বলেন, ১৮ বছরের ইন্টারমিডিয়েটে পড়ুয়া ছাত্রকে কমান্ডার বানিয়ে সাজা দিয়েছিল। অযৌক্তিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটিএম আজহারকে সাজা দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করি, আপিল বিভাগ এটিএম আজহারকে খালাস দিবেন।
সাক্ষীদের ত্রুটিপূর্ণ সাক্ষ্য উপস্থাপন করে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, একজন সাক্ষী বলেছেন, তিন মাইল দূর থেকে তিনি দেখেছেন নির্যাতন করতে। একজন সাক্ষী বলেছেন, এটিএম আজহার ডান হাত দিয়ে ভিকটিমের বাম গালে থাপ্পড় মারেন। সামনাসামনি থেকে থাপ্পড় দিলে তো বাম গালে লাগার কথা৷ মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে রাজনৈতিকভাবে, পরিকল্পিতভাবে এটিএম আজহারকে জড়ানো হয়েছে।
শুনানিতে শিশির মনির বলেন, সাক্ষী ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পর কোর্টে আসার পর দেখলাম সে ঘটনার তারিখ-সময় বলতে পারছে না। পরে অনেক সাক্ষীকে কোর্টে আনা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ওই সময় ১৭ জনের তালিকা দিয়ে বলা হয়েছিল এরা আদালতে আসতে পারবে না। ট্রাইব্যুনাল ওই আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। যার কারণে আসামি পক্ষ অনেক সাক্ষীকে জেরা করতে পারেনি। অথচ সাক্ষীদের জেরা করা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এটাই সাক্ষ্য আইনের বিধান। অথচ জেরা না করতে অ্যাক্ট ও রুলস পরিবর্তন করা হয়েছিল।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ওই সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আসার সুযোগ ছিল না। বিচারটা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তখন আমরা স্কাইপ কথোপকথন, মেইল যোগাযোগের বিষয়গুলো বার বার বলেছি। সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকে ট্রাইব্যুনালের গেইট থেকে অপহরণ করে ভারতে নিয়ে আটক করে রাখা হয়েছিল। আমরা সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চেয়ে আবেদন করলে তা খারিজ করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিতে না চাইলে তাকে আদালত থেকেই কারাগারে পাঠানো হয়।
জামায়াত নেতাদের প্রসঙ্গ টেনে শিশির মনির বলেন, ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচারের জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আইন করা হয়েছিল। সারা দেশে ২৮টি ট্রাইব্যুনাল করে বিচার শুরু হয়েছিল। অথচ ট্রাইব্যুনালে যেসব জামায়াত নেতাদের বিচার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোনো থানায় জিডি পর্যন্ত ছিল না। ১৯৭৩ সালের ওই আইন সংশোধন করে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার সিভিলিয়ানদের বিচারের বিধান করে। বিষয়টি নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন প্রয়াত বিচারপতি টিএইচ খান। সেখানে দেশি–বিদেশি আইনজ্ঞরাও অংশ নিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, এই আইন ও ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানের ছিল না।
এটিএম আজহারের বিষয়ে শিশির মনির বলেন, একজন সাক্ষী ৬ কিলোমিটার দূর থেকে দেখেছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে এটিএম আজহার ট্রেন থেকে নেমে গ্রামে আগুন দিয়েছে। ঘটনার স্থান বর্ণনা করা হয়েছে এক জায়গায়, সাক্ষী বলছে অন্য জায়গায়। একজন সাক্ষী বলছে, তার ছেলে–মেয়ে কয়টি তা সে জানে না। তার সাক্ষ্যও নেওয়া হয়েছে। একজন সাক্ষী বলেছে, তার বাবাকে কে মেরেছে তা তিনি দেখেননি, বাবাও তাকে বলেননি। অন্য একজন বলেছেন এটিএম আজহার মেরেছেন। একজন সাক্ষী পাচক। তিনি কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষকে চিনেন না, অন্য ছাত্র সংগঠনের নেতাদের চিনেন না। অথচ তিনি আজহারুল ইসলামকে চিনেন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
শুনানিতে শিশির মনির আরও বলেন, একজন সাক্ষী বলেছে, এটিএম আজহার ঝাড়ুয়ার বিলের গণহত্যার সঙ্গে জড়িত নন। এসব সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বলেছেন, এসব সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য না। পরে কয়েকটি অভিযোগ থেকে ওই বিচারপতি তাকে খালাসও দেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এরপর ওই রায় রিভিউ চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রিভিউ আবেদন শুনানি শেষে আপিল বিভাগ লিভ (আপিলের অনুমতি) মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এরপর আপিল শুনানি হয়।