লিবিয়ায় দালালদের নির্যাতনে নিহত মাদারীপুরের রাকিব, অভিযোগ পরিবারের

দালালের মাধ্যমে উন্নত জীবনের আশায় ইতালিতে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন মাদারীপুর সদরের রাকিব মহাজন। দীর্ঘ তিন বছর লিবিয়ার গেমঘরে দালাল চক্রের ভয়াবহ অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অবশেষে মারা গেছেন বলে খবর পেয়েছে তাঁর পরিবার। সেই খবরে পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পাড়া-প্রতিবেশীরা।
গতকাল বুধবার (২২ জানুয়ারি) রাতে রাকিব মহাজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তাঁর পরিবার। রাকিব সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের পখিরা গ্রামের নাজিম উদ্দিন মহাজনের ছেলে। এদিকে প্রশাসন থেকে আইনগত সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
নিহত রাকিবের পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তিন বছর আগে উন্নত জীবনের আশায় সদর উপজেলার মৃত ফটিক মৃধার ছেলে জাহাঙ্গীর মৃধার প্রলোভনে পড়েন রাকিব মহাজন। জাহাঙ্গীর তাঁর ভায়রাভাই শরীয়তপুরের পালং থানার ধানুকা ইউনিয়নের ছোট বিনোদপুর গ্রামের সোহাগ মাতুব্বরের মাধ্যমে ২৭ লাখ টাকায় ইতালিতে পৌঁছে দেওয়ার চুক্তি করেন। সেই মতো ২৭ লাখ টাকা দিয়ে তিন বছর আগে রাকিব পাড়ি জমান লিবিয়ায়। তবে লিবিয়ার নেওয়ার পর গেমঘরে আটকে রেখে আরও টাকার জন্য নির্যাতন চালাতে থাকেন সোহাগ মাতুব্বর। পরে রাকিবের বাবা নাজিম উদ্দিন মহাজন ধার-দেনা করে আরও পাঁচ লাখ টাকা দেন তাঁকে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। দুই বছর চার মাস পর আরেক দালাল সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রাহ্মন্দী গ্রামের মাজেদ খলিফাকে ধরে রাকিবের পরিবার। সোহাগ গেমঘর থেকে বেরিয়ে আবারও সেই গেমঘরের ফাঁদে পড়েন। তাঁকেও আট মাস আগে ১৫ লাখ টাকা দেন সোহাগের বাবা। কিন্তু তিনিও টাকা নিয়ে গেমঘরেই নির্যাতন চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে রাকিব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে লিবিয়ার একটি হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান রাকিব। এই মৃত্যুর খবর পরিবারকে দালাল মাজেদ খলিফাই জানান। দেন প্রাণহীন দেহের কয়েকটি ছবি-ভিডিও। এতে শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো পরিবারসহ এলাকাবাসীর মধ্যে।
এ ব্যাপারে নিহত রাকিবের বাবা নাজিম উদ্দিন মহাজন বলেন, ‘দফায় দফায় টাকা দিয়ে আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। এ পর্যন্ত সোহাগ আর মাজেদকে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েছি। এরপর এখন আমার ছেলের মৃত্যুর খবর শুনতে হলো। আমার ছেলেকে না খাইয়ে মেরে ফেলছে। কয়েকদিন আগেও আমার ছেলে ভিডিওতে তার নির্যাতনের কথা বলেছে। আর বাঁচার জন্য আকুতি করেছে। কিন্তু আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না।
এভাবে দালাল চক্রের কারণে রাকিরের মৃত্যকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না পরিবার ও এলাকাবাসী। তারা দোষীদের বিচার দাবি করছেন। সেই সঙ্গে রাকিবের মরদেহ দেশে আনারও দাবি করেন।
নিহত রাকিবের ছোট চাচা শাহজালাল মহাজন বলেন, ‘নির্যাতন করে আমার ভাতিজাকে হত্যা করেছে দালালরা। এখন তারা বলে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই। এভাবে যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।
অভিযোগের বিষয় স্থানীয় দালাল জাহাঙ্গীর মৃধা বলেন, সোহাগ আমার ভায়রা বিধায় আমাকে জড়ানো হচ্ছে। কেউ বলতে পারবে না যে, আমি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। আর ওই ছেলে অসুস্থ হয়ে লিবিয়ায় মারা গেছে। আমার ভায়রা বরং সেখানে ট্রিটমেন্ট করেছে। এর বেশি কিছু জানি না।
আর মাজেদ খলিফার বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা বলেছেন, মৃত্যুর বিষয়টি জানার তার পরিবার বাড়ি থেকে পালিয়েছে।
এদিকে মাদারীপুর জেলা পুলিশের তথ্য মতে, গত বছর লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মাদারীপুর জেলার অন্তত শতাধিক মানুষ মারা গেছে। এরই মধ্যে প্রায় ২০০’ মামলা হয়েছে পাঁচ শতাধিক দালালের বিরুদ্ধে। কিন্তু মামলায় জামিন পেয়ে পুনরায় দালালিতে যুক্ত হয় তারা।
এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স উল্লেখ করে পুলিশ সুপার মো. সাইফুজ্জামান বলেন, বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি মাদারীপুরে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে।
একটি সূত্র মতে, মাদারীপুরে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালিতে মানবপাচার করছে প্রতারক চক্র। এদের মদদ দিচ্ছে রাজনৈতিক একটি মহল। ফলে ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাচ্ছে দালাল চক্র।