রায়পুরায় টেঁটাযুদ্ধ : মামলা করতে স্বজনদের অনীহা
নরসিংদীর রায়পুরার চরাঞ্চলে আওয়ামী লীগের বর্তমান ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সমর্থকদের সংঘর্ষে চার গ্রামবাসী নিহতের পর চারদিনেও পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়নি। মামলা নিয়ে অনীহা প্রকাশ করেছেন নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা।
আবার কারো অভিযোগ, পুলিশ মামলা নিচ্ছে না। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়েছে গ্রামবাসীর মধ্যে।
গত শনিবার থেকে সোমবার টানা তিনদিন নির্বাচনী বিরোধ ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে রায়পুরা উপজেলার নীলক্ষা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হক সরকার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সোমবার দুপুরের সংঘর্ষে আবদুল হক সরকার পক্ষের ইউনিয়নটির আমিরাবাদ গ্রামের মানিক মিয়া (৪৫), একই গ্রামের শাহজাহান মিয়া (২৭), সোনাকান্দি গ্রামের খোকন মিয়া (৩২) ও একই গ্রামের মামুন মিয়া (২২) নিহত হন। এর মধ্যে শাহজাহান টেঁটাবিদ্ধ হয়ে এবং বাকিরা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে এখন পর্যন্ত তিনটি মামলা করেছে। তিন মামলায় দুই হাজার গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার হয় ১৬ জন।
চারদিনেও মামলা না হওয়া এবং এই নিয়ে স্বজনদের অনাগ্রহের বিষয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নানান আলোচনা চলছে। স্থানীয়দের অনেকে জানান, সংঘর্ষ হয়েছে নীলক্ষা, বীরগাঁও, দড়িগাঁও ও হরিপুর গ্রামে। কিন্তু যাঁরা মারা গেলেন তাদের কেউ ওই চার গ্রামের বাসিন্দা নয়। তারা আবদুল হক পক্ষের হয়ে ভিন্ন গ্রাম থেকে এসে সংঘর্ষে যোগ দেন। এসব কারণে স্বজনদের পরিবারের মধ্যে পুলিশি ভীতি রয়েছে। মামলা করে উল্টো বিপদে পড়ে যেতে পারেন- এমন অজানা শঙ্কায় ভুগছেন তাঁরা। এই কারণে মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে।
এ ছাড়া নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, তাঁরা মূলত আবদুল হক সরকার পক্ষের লোক। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রাজি উদ্দিন আহমেদ পক্ষটির প্রতি বিরক্ত। গতকাল বুধবার দুপুরে সংসদ সদস্য এলাকায় শান্তি সমাবেশ করে ঘোষণা দেন, শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনে ১৪ থেকে ৬৫ বছর বয়সী গ্রামবাসীকে গণগ্রেপ্তার করা হবে। এই ঘোষণার পর গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই রাতেই পুলিশ অভিযানে নামে। ফলে বিশেষ করে আবদুল হক সরকার পক্ষের যারা গ্রামে অবস্থান করছিল তাদের অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এই অবস্থায় মামলা করে সুবিধা করা যাবে না-এমন ধারণা আছে নিহতদের পরিবারে।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবার গরিব। তাদের ঘরে সামান্য টাকাও নেই। খাবার জোগাড় করতে পারছে না। পক্ষটি থেকেও আর্থিক জোগান আসছে না। মূলত এসব কারণে তারা মামলার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
নিহত মানিকের পেশা ছিল কৃষি কাজ। সামান্য জমিতে চাষ করে স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন তিনি। ঘটনার চারদিনেও মামলা না করার কারণ জানতে চাইলে মানিকের ছোট ভাই সুলায়মান মিয়া অভিযোগ করেন, ঘটনার পর পরই মামলা করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু রায়পুরা থানা পুলিশ তাঁদের মামলা নিতে রাজি হয়নি। শেষে বাধ্য হয়ে বৃহস্পতিবার নরসিংদী আদালতে এজাহার জমা দেন তিনি।
চারদিনেও মামলার প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে পারেননি টেঁটাবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া শাহজাহান মিয়ার পরিবারের সদস্যরা। শাহজাহান পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন। পেশার আয় দিয়ে তিনি স্ত্রী ও ছয় সন্তানের ব্যয় নির্বাহ করতেন।
শাহজাহানের বড় ছেলে শরিফ মিয়া বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, টাকা নাই। মামলা করতে টাকা লাগে। টাকা হলে মামলার চিন্তা করব।’ একই সঙ্গে তিনি জানান, পরিবেশ তাদের পক্ষে নেই। যাদের ইঙ্গিতে অনেক কিছু হয় এমন কারো আশীর্বাদ তাঁদের পক্ষে নেই।
নিহত খোকন কাঁচামালের ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে বড় সন্তান সুমাইয়ার বয়স পাঁচ বছর। খোকনের মৃত্যুর পর বর্তমানে তাঁর পরিবার চালানোর আর কেউ নেই।
মামলা না করার ব্যাপারে খোকনের বড় ভাই ফারুক মিয়া বলেন, ‘নানা সমস্যা আছে। সব কথা তো আর বলা যায় না। তবে আমরা বসব। বসে মামলার সিদ্ধান্ত নেব।’
নিহত মামুন ছয় মাস আগে বিয়ে করেন। পেশায় ছিলেন মাটি শ্রমিক। তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। মামলার বিষয়ে মামুনের বাবা মঙ্গল মিয়ার মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। মঙ্গল মিয়া বলেন, ‘আমরার মানুষ মরল, আবার পুলিশ আমরারেই দৌঁড়ায়। এই অবস্থায় মামলা করলে কী হইব? পুলিশ কি আসামি ধরব?’
জানতে চাইলে রায়পুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নিহত পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ মামলা করতে আসেনি। পুলিশ মামলা নিচ্ছে না এমন অভিযোগ সত্য নয়। এজাহার পেলে অবশ্যই মামলা নেওয়া হতো।’