রাজশাহীর ‘নিখোঁজদের’ অতীত খতিয়ে দেখছে পুলিশ
নিখোঁজদের তথ্য পাওয়া মাত্রই তার অতীত সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে রাজশাহী জেলা ও মহানগর পুলিশ। নিখোঁজ হওয়ার আগে তারা কী করত, কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাদের আচার ব্যবহার কেমন ছিল এবং হঠাৎ করেই তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন এসেছিল কী না, সেসব বিষয়ই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) মোয়াজ্জেম হোসেন ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এসপি মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, জেলার ৯ থানায় সাম্প্রতিক সময়ে কেউ নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হলেই সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। নিখোঁজদের সন্ধান পেতে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি তৎপরতা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি নিখোঁজ ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়ার কারণ খোঁজা হচ্ছে। আর প্রত্যেক নিখোঁজ ব্যক্তির এলাকায় গিয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা খোঁজ নিচ্ছেন।
এসপি জানান, নিখোঁজদের অতীতের খোঁজ নিতে গিয়ে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী বাগমারার শরিফুল ইসলামের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার ‘শক্ত’ প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর তানোরের বাসারুজ্জামান ওরফে আবুল বাসার নামে আরেক যুবকও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। র্যাবের প্রথম দফার নিখোঁজ তালিকায় এই বাসারের নাম ছিল।
র্যাবের ওই তালিকার বাইরে জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার দুই যুবক ও দুই কিশোর নিখোঁজ রয়েছে। তারা হলো উপজেলার লস্করহাটি গ্রামের আবদুর রহিম (১৮), উপজেলা সদরের শাহিন রেজা (২০), হরিশংকরপুর গ্রামের আমিন (১৩) ও সাইফুল ইসলাম (১৬)।
এদের মধ্যে আবদুর রহিম ও শাহিন রেজা রাজশাহী নগরীর একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত। গত জুন থেকে তারা ‘রহস্যজনকভাবে’ নিখোঁজ। তারা নিখোঁজ থাকার ব্যাপারে নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় জিডি হয়েছে। মহানগর পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশও তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে।
ওদিকে সাইফুল ইসলাম ও আমিন সম্পর্কে চাচাতো ভাই এবং তারা একসঙ্গেই নিখোঁজ হয়। তবে তাদের বয়স কম হওয়ায় ঠিক কী কারণে তারা নিখোঁজ হয়েছে, তা উদঘাটন করতে পুলিশকে বেগ পেতে হচ্ছে।
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অনুপস্থিত ৩০ শিক্ষার্থীর ব্যাপারেও অনুসন্ধান চালাচ্ছে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মজিবুল হক আজাদ খান বলেন, সম্প্রতি রাবি প্রশাসনের কাছে নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের তালিকা চায় পুলিশ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের কাছে নিখোঁজদের তালিকা হস্তান্তর করা হয়। তালিকাভুক্ত বিভিন্ন বর্ষের এসব শিক্ষার্থীর সবাই ড্রপআউট।
আরএমপির গোয়েন্দা শাখার একটি সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে সেগুলো যাচাই করে দেখা হচ্ছে। এ তালিকায় ড্রপআউট হওয়া ৩০ শিক্ষার্থীর মধ্যে আরবি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর দীর্ঘদিন থেকে খোঁজ নেই। বাকিদের অবস্থানের ব্যাপারেও পুলিশ নিশ্চিত হতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
তবে গোয়েন্দা সংস্থা বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তালিকা প্রকাশ করতে রাজি নয়। কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়া তাদের জঙ্গি বা অপরাধী বলা যাবে না বলে মনে করছে সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া ছাড়াও বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীরা ড্রপআউট হয়ে থাকে। তাই এই তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের যাবতীয় বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আরএমপির মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম বলেন, ‘ড্রপআউট শিক্ষর্থীদের ব্যাপারে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। তাদের অবস্থান শনাক্তের জন্য আমরা অনুসন্ধান চালাচ্ছি। তবে এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এ কারণে তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের ব্যাপারে আমরা এই মুহূর্তে গণমাধ্যমকর্মীদের পরিপূর্ণ তথ্য দিতে পারছি না।’
আরএমপি মুখপাত্র জানান, রাজশাহী মহানগরীতে অবস্থিত সব সরকারি-বেসরকারি কলেজ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখোঁজ শিক্ষার্থীদেরও তালিকা চাওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান তাদের তালিকা দিয়েছে। আগামী দুই থেকে তিনদিনের মধ্যে বাকিরাও তালিকা হস্তান্তর করবে। এই মুহূর্তে প্রাপ্ত তালিকার নিখোঁজদের ব্যাপারেই খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। এদের কারো বাড়ি অন্য কোনো জেলায় হলে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোকে তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তথ্য সংগ্রহ করছে।
আরএমপির মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থী অনিয়মিত পড়লে তা সহজে বোঝার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্স মেশিন বসানোর জন্য বলা হচ্ছে। এ জন্য নির্দিষ্ট করে সময় বেঁধে দেওয়া না হলেও যত দ্রুত সম্ভব তা করার জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কোনো শিক্ষার্থী একদিন অনুপস্থিত হলেই তার ব্যাপারে খোঁজ নেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। টানা অনুপস্থিত হলেই জানাতে হবে পুলিশকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্স নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল আইডি কার্ড বিতরণ করলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বিভাগগুলোতে এখন পর্যন্ত ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্স মেশিন বসাতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে শিক্ষার্থীরাও ডিজিটাল কার্ড পেয়েও এর ব্যবহার করতে পারছে না বলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
তবে ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্সের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্সের ব্যাপারে সব কাজ শেষ করতে পারিনি। তবে প্রশাসন ভবনসহ কয়েকটি জায়গায় ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্স স্থাপন করা হয়েছে এবং এর কার্যক্রম চলছে। আর কিছু সময়ের মধ্যে আমরা প্রতিটি বিভাগে ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্সের কাজ শেষ করতে পারব।’