নর্থ সাউথের বাশার মালয়েশিয়ায় গিয়ে নিখোঁজ
রাজধানীর গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১০ যুবকের সন্ধান চেয়ে তাঁদের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। নিখোঁজ ওই ১০ যুবকের একজন রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাসিন্দা ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান ওরফে আবুল বাশার।
এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী খুন হওয়ার পর বাগমারা উপজেলার শরিফুল ইসলাম নামের এক যুবকের নিখোঁজ থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। শরিফুল রাবির ইংরেজি বিভাগেরই শিক্ষার্থী।
নিখোঁজ বাশার ও শরিফুলের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে রাজশাহীর পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সে বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
পুলিশ ও পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, বাড়ি ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর তাঁরা জানতে পারেন, মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান ওরফে আবুল বাশার নিখোঁজ আছেন। বাশার তানোরের লালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজ উদ্দিনের ছেলে। সিরাজ উদ্দিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে কোনো পদে নেই। বাশারের মামা আবুল কাশেম তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও তালান্দ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। তাঁদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
পরিবারের সদস্যদের ভাষ্যমতে, বাশার ২০০৭ সালে ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে পাস করার পর একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছিলেন। দুই বছরের বেশি সময় ঢাকা তেজগাঁওয়ে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। ছয় থেকে সাত মাস আগে তেজগাঁও এলাকার শ্বশুরবাড়ি থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে বাশার বাড়ি থেকে বের হন। এরপর তার খোঁজ মেলেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাসারের পরিবারের এক সদস্য জানান, গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার আগে নিহত পাঁচ জঙ্গি দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিল। এ ঘটনার পর কোনো পরিবারের কেউ নিখোঁজ থাকলে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর অনুরোধ জানানো হয়। এ ঘোষণার পর বাশারের শ্বশুর ঈদের আগে ঢাকার তেজগাঁও থানায় মেয়ের জামাইয়ের সন্ধান চেয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপরই বিষয়টি জানাজানি হয়।
বাশারের বাবা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হলেও তানোর উপজেলার লালপুর গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে বাশার সবার বড়।
আজ মঙ্গলবার সকালে লালপুর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বাশারের বাবা সিরাজ উদ্দীনকে পাওয়া যায়নি। ছেলের খোঁজে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন।
বাশার ছিলেন লাজুক প্রকৃতির
বাশারের মা বানিসা বেগম বানু জানান, তাঁর ছেলে বাশার ছোট থেকেই লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। গ্রামে ছেলেদের সঙ্গে কম মিশতেন। তাঁদের আরেকটি বাড়ি আছে রাজশাহী শহরে। ভালো পড়াশোনা করার জন্য ছোট থেকেই রাজশাহীতে থাকতেন বাশার। ১০ বছর আগে তিনি ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেই থেকে বাশার বাড়িতে খুব কম আসতেন। দুই বছর আগে ঢাকার তেজগাঁওয়ে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতেই ঘরজামাই থাকতেন। বিয়ের পর গ্রামের বাড়িতে মাত্র একবার এসেছিলেন। সাত মাস আগে বাশার দুই মাসের জন্য অফিসের কাজে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন বলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের হন। সেই থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ নেই।
লালপুর গ্রামে বাশারদের প্রতিবেশীরা জানান, বাশার ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। ছোট থেকেই তিনি শহরের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেছেন। গ্রামে খুব কম আসতেন। মাঝেমধ্যে এলেও তিনি গ্রামের কারো সঙ্গে মিশতেন না। এ কারণে গ্রামের অনেকেই তাঁকে চেনে না।
বাশারের মামা ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম জানান, পারিবারিক কিছু দ্বন্দ্বের জন্য বোন-ভগ্নিপতির সঙ্গে দীর্ঘদিন মনোমালিন্য থাকায় তাঁদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। কয়েকদিন আগে পত্রপত্রিকায় বাশারের নিখোঁজের ছবি প্রকাশ পাওয়ার পর বিষয়টি অবাক করেছে তাঁকে।
তানোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সালাম জানান, তেজগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরির (জিডি) পর বাশারের গ্রামের বাড়িতে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়েছে। বাশার লেখাপড়ার সুবাদে ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে বাড়ির বাইরে শহরে থেকেছেন। দীর্ঘদিন গ্রামে না আসায় এমনকি নিজের মামাও তাঁর বর্তমান ছবি দেখে চিনতে পারছেন না।
ওসি জানান, কী উদ্দেশ্যে বাশার নিখোঁজ রয়েছেন বা দেশে না বিদেশে রয়েছেন তার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, চলতি বছর রাবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী খুনের ঘটনার পর ওই বিভাগেরই শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলামের নিখোঁজ থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। সেই সময় ওই নিখোঁজ শিক্ষার্থীর বাবা আবদুল হাকিম ও ভাই আরিফুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকও করেছিল পুলিশ।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সরদার তমিজউদ্দীন আহমেদ জানান, প্রায় এক বছর ধরে শরিফুলকে খোঁজা হচ্ছে।
নিখোঁজ শরিফুলের পরিবারের দাবি, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শরিফুলের কোনো যোগাযোগ নেই।
এদিকে পরিবারের আর কেউ বিশেষ করে যুবক ও তরুণ বয়সের কেউ নিখোঁজ রয়েছে কি না, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে রাজশাহী মহানগর ও জেলা পুলিশ।
জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিদর্শক শরিফুল ইসলাম জানান, এ ব্যাপারে জেলার নয়টি থানায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। জেলার আর কেউ নিখোঁজ রয়েছে কি না, সে সম্পর্কে আগামী দু-তিনদিনের মধ্যে তথ্য পাওয়া যাবে।
একই তথ্য জানান রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের।