ফেসবুক পেজ পাল্টে দিল সুলতানের জীবন
জন্মের পর খেলার সাথিরা যখন বেড়ে উঠছিল, তখন আবুল হাশেম ও ফাতেমার শারীরিক গঠন ছিল একই রকম। সব দেখে-বুঝেও জনবিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের হতদরিদ্র শারীরিক প্রতিবন্ধী বাবা সুলতান বেপারী নিজের মতোই নিয়তির কাছে ছেড়ে দেন প্রিয় সন্তানদের ভবিষ্যৎ।
সেই ছোট্ট আবুল হাশেম এখন নবম শ্রেণি ও ফাতেমা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে মেধার দিক দিয়ে এই দুই ভাইবোন সবাইকে ছাড়ালেও দারিদ্র্যের কুঠারাঘাতে বারবার থমকে যাচ্ছিল দুর্গম এই পথচলা। ঠিক তখনই সরকারি কর্মকর্তাদের ফেসবুকের পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন গ্রুপ পেজের একটি পোস্ট নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছে এই পরিবারটির।
ফেসবুকের এই পেজটির মাধ্যমে এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা নানাভাবে তাদের অধীন অধিদপ্তরকে শিবচরের পদ্মাবেষ্টিত চরজানাজাতের প্রতিবন্ধী সুলতানের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
উপজেলা খাসজমি বন্দোবস্ত কমিটি পরিবারটিকে চরাঞ্চলের ২৫ শতাংশ খাসজমি বরাদ্দসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার পদ্মা নদীবেষ্টিত জনবিচ্ছিন্ন চরজানাজাত ইউনিয়নের সাহেদ আলী শেখেরকান্দি গ্রামের দিনমজুর আবদুল বেপারীর ছেলে সুলতান বেপারী (৪৫) জন্ম থেকেই ক্ষুদ্রকায় শারীরিক গঠনের। বিয়ের পর তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলের জন্ম হয়। এর মধ্যে বড় মেয়ে শেফালী ছাড়া ছোট মেয়ে ফাতেমা ও একমাত্র ছেলে আবুল হাশেম বাবার মতই ক্ষুদ্রকায় হয়ে জন্ম নেয়। অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করে ও ঘরের মধ্যেই এক পাশে চায়ের দোকান করে কোনোরকমে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ করছিলেন সুলতান।
এরই মধ্যে ধারদেনা করে বড় মেয়ের বিয়েও দেন তিনি। ছোট মেয়ে ফাতেমা বর্তমানে চরজানাজাত ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ও ছেলে আবুল হাশেম নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। তারা উভয়েই বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী।
ভূমিহীন পরিবার হওয়ায় কয়েক বছর আগে উপজেলা খাসজমি বন্দোবস্ত কমিটির কাছে ভূমি চেয়ে একটি আবেদন করেন সুলতান। সম্প্রতি উপজেলা খাসজমি বন্দোবস্ত কমিটি সুলতানকে ২৫ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়।
উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি-এসিল্যান্ড) শরিফুল ইসলাম দলিল হস্তান্তরের একটি ছবি ফেসবুকের পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন গ্রুপ পেজে পোস্ট করেন । পোস্টটি দেখে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) গাজী নুরুল কবির, বিভাগীয় কমিশনার হেলালউদ্দিন আহমেদ, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামালউদ্দিন বিশ্বাসহ প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ওই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য উপজেলা প্রশাসন ও স্ব-স্ব দপ্তরকে নির্দেশ দেন।
উপজেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয় দেশের সব কর্মকর্তার মধ্যে।
এরপর গতকাল বুধবার বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ফাতেমা ও আবুল হাশেমকে উপজেলা পরিষদের আট হাজার টাকা শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া দুজনকে মাসিক ৬০০ টাকা করে সমাজসেবা দপ্তরের শিক্ষাবৃত্তি চালু করা হয়। সুলতানের হাতে দেওয়া হয় ৫০ কেজি চাল। এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সহজ কিস্তিতে ২৫ হাজার টাকার ঋণও দেওয়া হয়।
এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান আহমেদ, উপজেলার এসিল্যান্ড শরিফুল ইসলাম, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সহায়তা পেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী সুলতান বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হওয়ায় সব সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই পেয়েছি। আজ কর্মকর্তাদের কারণে শুধু জমি আর টাকা বা সাহায্যই পাচ্ছি না, যে সম্মান বা সামাজিক অবস্থান এখন পাচ্ছি, তা কোনো দিনও পাইনি। আমি সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। মাসিক বৃত্তি পাওয়ায় প্রতিবন্ধী এই দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া আর বন্ধ হবে না।’
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হুমায়ন কবির বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের ফেসবুক পেজ থেকে দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি অবগত হয়েছেন। তাঁদের নির্দেশনা মতো বিভিন্ন দপ্তর থেকে সুলতানের পরিবারের জন্য সহায়তা হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলার এসিল্যান্ড শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘খাসজমি পরিবারটির জন্য বরাদ্দ দেওয়ার পর ওই ছবি আমি আমাদের ফেসবুক পেজে দিলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টির ভূয়সী প্রশংসা করেন। সুলতানের পরিবারের জন্য বিভিন্ন অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
উপজেলা খাসজমি বন্দোবস্ত কমিটির সভাপতি ও ইউএনও ইমরান আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এ উদ্যোগ দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। কমিটির পক্ষ থেকে ২৫ শতাংশ জমি সুলতানকে রেজিস্ট্রি ও মিউটেশন করে দেওয়া ছাড়াও তাঁর দুই প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য শিক্ষাবৃত্তিসহ নানা অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’