‘এই মৃত্যু বিজয়ের, তাই এমন চিহ্ন দেখিয়েছি’

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় দেখা করেন তাঁর স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ অন্য স্বজনরা। কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় তাঁরা গণমাধ্যমের সামনে বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ণ দেখান।
এর আগে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন সাজা পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে বের হয়ে বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখান আবদুল কাদের মোল্লা। এটি ক্ষুব্ধ করে লাখো মানুষকে। শাহবাগে শুরু হয় কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন। জন্ম নেয় গণজাগরণ মঞ্চ। অব্যাহত আন্দোলনের মুখে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয় সরকার।
সংশোধিত আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এর পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আপিল আবেদন মঞ্জুর করে মৃত্যুদণ্ড দেন কাদের মোল্লাকে। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় কাদের মোল্লার। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার রাতে দেখা করে বেরিয়ে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা ‘ভি’ চিহ্ন দেখান।
কেন বিজয় চিহ্ন—জানতে চাইলে কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামি আজ মঙ্গলবার দুপুরে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা এটিকে শাহাদাতের মৃত্যু বলে মনে করি। সে জন্য আমরা পিতার সঙ্গে দেখা করে কারাগার থেকে বেরোনোর পর এই মৃত্যুকে বিজয় হিসেবে দেখে বিজয়সূচক চিহ্ন দেখিয়েছি।’
‘আপনারা দেখবেন, কারাগারে ঢোকার আগেও আমাদের পরিবারের কোনো সদস্য কান্নাকাটি করেনি বা উদ্বেগও প্রকাশ করেনি। কারণ আমরা মনে করি, এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। বর্তমান সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। আমরা সে জন্য এটিকে শাহাদাতের মৃত্যু মনে করেই বিজয় চিহ্ন দেখিয়েছি,’ যোগ করেন ওয়ামি।
কামারুজ্জামানের ছেলে অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকার মিথ্যা ও বানোয়াট সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে একটি রাজনৈতিক রায় দিয়ে তাঁর পিতাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই চিহ্ন দেখানো রাষ্ট্র বা আদালতের প্রতি এক ধরনের ধৃষ্টতা বলে মনে করা হয়—এমন কথার জবাবে ওয়ামি বলেন, ‘একে আমরা কোনো রকমের ধৃষ্টতার প্রকাশ বলে মনে করি না।’
এর আগে কাদের মোল্লা ও তাঁর পরিবার যে কারণে বিজয়সূচক চিহ্ণ প্রদর্শন করেছিলেন, একই কারণে কামারুজ্জামানের পরিবারও ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছে বলে জানান হাসান ইকবাল ওয়ামি।
গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন।
২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত বছরের ৩ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। চলতি বছরের গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়। এর পর ১৯ ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পৌঁছায়। ৫ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় কামারুজ্জামানের পক্ষে রিভিউ আবেদন করা হয়।
২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী সাতটি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুটিতে মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে যাবজ্জীবন ও একটিতে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।