‘আর নয়, এবার পাল্টা আঘাত’
ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে বিজয়ী ও বিজিতদের নিয়েই ছিল সভাটি। ছিলেন উপজেলা, পৌর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। ছিলেন রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতা।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সভাটি একপর্যায়ে পরিণত হয়, ক্ষোভ, হতাশা আর রাগের বহিঃপ্রকাশের সভায়। একের পর এক নেতা যখন কখনো আবেগে, কখনো ক্ষোভে বক্তব্য রাখছিলেন, তখন মিলনায়তন জুড়ে সুনসান নীরবতা আর পাশাপাশি তীব্র করতালিতে একজন সমর্থন জানাচ্ছিলেন আরেকজনকে। কী বলেছিলেন তারা? সবার সমস্ত ক্ষোভ আর অভিযোগ ছিল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) দিকে। এই তিন আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র রাজনীতির কাছে, আওয়ামী লীগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড়ের মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে, এমন অভিযোগই ছিল সবার।
ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে, সেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এভাবে চলতে পারে না। নির্বাচনে জয়ী হয়েও বিপদ, পরাজিত হয়েও। সন্তু লারমা ও তার দোসরদের কারণে আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেঁচে থাকা এবং স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরাই কঠিন হয়ে পড়েছে। যদি অচিরেই পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে, আঞ্চলিক দলগুলোর তাণ্ডব বন্ধ করা না হয়, তবে পার্বত্য রাঙামাটির সব উপজেলা ও জেলার নেতাকর্মীরা একযোগে দলীয় সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র পাঠাব। তারা বলেন, সারা বাংলাদেশ যেভাবে চলছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম তার ঠিক উল্টোপথে। এখানে কারা ক্ষমতাসীন দল বোঝা যায় না। আঞ্চলিক দলের কাছে জিম্মি হয়ে আছে জাতীয় রাজনীতি।
আওয়ামী লীগের নেতারা আরো বলেন, স্থানীয় প্রশাসন অজ্ঞাত কারণে আঞ্চলিক দলগুলোকে তোয়াজ করে চলে। সারা দেশে হরতাল বা অবরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে থাকলেও, রাঙামাটিতে এরা আঞ্চলিক দলগুলোর ভয়ে বা অন্য কোনো কারণে তটস্থ থাকে।
শুধু একজন নয়, সবার বক্তব্যেই ছিল ক্ষোভের আগুন। সবার ক্ষোভ হতাশা আর রাগের পর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। এখন থেকে আঘাত এলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও পাল্টা আঘাত করবে।’ তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জেএসএসে অবরোধ প্রত্যাহার করা না হলে, ২০ জুন থেকে মাঠে থাকার নির্দেশ দেন।
সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বর বলেন, ‘প্রশাসন যদি না পারে, বলে দিক, আমরা তাহলে নিজেদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে যা করার নিজেরাই করব। আমরা জানি, কীভাবে কি করতে হয়।’ তিনি আঞ্চলিক দলগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘অনেক হয়েছে, আর না।’
সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) যদি আগামী ১৯, ২০ ও ২১ জুন ডাকা অবরোধ প্রত্যাহার না করে তবে আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীকে মাঠে থেকে সেই অবরোধ প্রতিহত করারও সিদ্ধান্ত নেয় রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ। জেলা শহর থেকে উপজেলা সর্বত্র অবরোধ প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, ‘আমরা দেখতে চাই তারা অবরোধ প্রত্যাহার করে কি না কিংবা ১৯ তারিখ অবরোধ পালন করে কি না, এরপর তারা অন্য আওয়ামী লীগ দেখবে।’
দীপংকর তালুকদারের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য দেন তিন পার্বত্য জেলার সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান, চিংকিউ রোয়াজা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বরসহ বিভিন্ন উপজেলার নেতারা।
সভায় বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র দাপটের কাছে অসহায়ত্বের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। কেউ কেউ নির্বাচনে নিজ এলাকাতেই কাজ করতে না পারা এবং প্রশাসনের অসহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরেন। প্রায় সব প্রার্থীই জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে নির্বাচনের পরও বিভিন্ন এলাকায় হুমকি, অপহরণ ও নানাভাবে চাপ সৃষ্টির অভিযোগ করে এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দলের নেতাদের প্রতি অনুরোধ জানান।
আওয়ামী লীগের নেতারা আরো বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বানের জলে ভেসে আসা বা ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া দল নয়। লড়াই-সংগ্রাম কী জিনিস তা আওয়ামী লীগ জানে। তারা জনসংহতি সমিতি ও আঞ্চলিক দলগুলোকে ভালো হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, পরিণতি শুভ হবে না। আর যদি একজন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হুমকি, মারধর বা অপহরণ করা হয়, এর জবাব সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হবে।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর বলেন, ‘আমরা সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করার পর্যায়ে আছি। এভাবে চলতে পারে না। ওদের খেয়াল খুশির কাছে জিম্মি পার্বত্যবাসী। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরীহ পাহাড়ি বাঙালিদের অস্ত্রের মুখে দমিয়ে রেখে ওরা যাচ্ছে তাই করবে, এটা তো চলতে পারে না। এখন থেকে তাই পাল্টা আঘাত করা হবে।’