রানা প্লাজা ধস : নিষ্পত্তি হয়নি তিন মামলার
রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে করা তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। অথচ এর একটিও নিষ্পত্তি হয়নি। এ ছাড়া ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত হাইকোর্টে করা একটি রিটের শুনানি তিন বছর ধরে অপেক্ষমাণ রয়েছে।
সোহেল রানার বিরুদ্ধে পুলিশের করা ভবনধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত আইনের মামলা এবং দুদকের করা সম্পদের হিসাবের বিবরণী জমা না দেওয়াসংক্রান্ত মামলা বিচারিক আদালতে অভিযোগ গঠনের জন্য রয়েছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবীর বাবুল সাংবাদিকদের বলেন, দুটি আদালতে আগামী ২৮ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত মামলার আসামিদের উপস্থিতির জন্য দিন রয়েছে। এরপর অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করা হবে।
এ ছাড়া নিহতের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি, নিহত ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত রিটের ওপর তিন বছরেও চূড়ান্ত শুনানি হয়নি। এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারিভাবে দেওয়া অর্থ ক্ষতিপূরণ নয় বরঞ্চ বিদেশি সাহায্য দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন রিটকারী আইনজীবী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিটকারী ইউনূস আলী আকন্দ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় রিটের ওপর শুনানির জন্য একটি বেঞ্চে নির্ধারিত ছিল। কিন্তু বেঞ্চটি ভেঙে যাওয়ার পর আর শুনানি হয়নি। তবে আশা করছি শিগগিরই এ বিষয়ে পুনরায় শুনানি শুরু হবে।
‘রিটে নিহত-আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। এর ওপর এখানো শুনানি হয়নি। শুনানির আগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, সেসব অর্থ ক্ষতিপূরণ নয়, বরং বিদেশ থেকে পাওয়া অনুদান। এটিকে ক্ষতিপূরণ বলা ভুল হবে। বরং ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ হবে মামলার শুনানির পর।’
এ বিষয়ে আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মামলাটি শুনানির অপক্ষায় রয়েছে। আশা করি অবকাশকালীন ছুটি শেষে শুনানি হবে।’
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পরের দিন ২৫ এপ্রিল আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ (ব্লাস্ট) কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে চারটি রিট আবেদন করেন। একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রুল দেন।
একই সঙ্গে রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির মাত্রা ও ক্ষতিপূরণের হার নির্ধারণ করতে আদালত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন। সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি।
ওই কমিটি দুটি উপকমিটি গঠন করে। উপকমিটির সদস্যরা প্রত্যেক নিহত, নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিকের জন্য ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেন। আর আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী শ্রমিকদের জন্য নির্ধারণ করেন দেড় লাখ থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা।
বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি আবদুর রবের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে গত বছরের ২০ এপ্রিল ক্ষতিপূরণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পর হাইকোর্টের বেঞ্চ পুনর্গঠন হওয়ায় আর শুনানি হয়নি।
তিন মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
হত্যা মামলা : রানাসহ ৪১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দিয়েছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মৃত্যু ঘটানোসহ দণ্ডবিধির ৩০২, ৩২৬, ৩২৫, ৩৩৭, ৩৩৮, ৪২৭, ৪৬৫, ৪৭১, ২১২, ১১৪, ১০৯, ৩৪ ধারায় বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামানের আদালতে বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে হত্যা মামলাটি। এ মামলার ৪১ আসামির মধ্যে ১২ জন পলাতক। রানাসহ ছয়জন কারাগারে এবং বাকিরা জামিনে রয়েছেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এ মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
ইমারত নির্মাণের মামলা : ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে রানার বাবা আবদুল খালেক এবং মা মর্জিনা বেগমসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় মামলাটি করা হয়। এর তদন্তে ভবনের নকশায় ত্রুটি, অনুমোদন না নিয়ে ওপরের দিকে সম্প্রসারণ এবং নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের তথ্য উঠে আসে। তবে এ মামলার অভিযোগপত্রে ১৮ জনকে আসামি করেন তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু এ মামলায় রানাকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে আদালতের নির্দেশে নতুন করে এ মামলার তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে নকশা জালিয়াতির জন্য রানাকে দায়ী করা হয়। এ মামলা ও অভিযোগপত্র গ্রহণের ওপর শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
দুদকের মামলা : সম্পদের তথ্য চেয়ে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল চিঠি দেয় দুদক। কারাগারে থাকা অবস্থায় তথ্য না দিয়ে সময় চেয়ে আবেদন করেন রানা। দুদকের কাছে আবেদনটি গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় গত বছরের ২০ মে দুদকের উপপরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে রমনা থানায় সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলাটিও নিম্ন আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণের জন্য শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
ঘটনার বিবরণ : ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভবনধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কত সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও শেষ পর্যন্ত তিন হাজার ৬৬৫ জন মানুষকে জীবিত এবং মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এর মাঝে এক হাজার ১৩৫ জনকে মৃত এবং দুই হাজার ৪৩৮ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ৮৪৩টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৫৯টি লাশ হস্তান্তর করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে। ২৩৪টি লাশ অশনাক্ত অবস্থায় জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এখনো অপরিচিত যারা : রানা প্লাজার ট্র্যাজেডিতে সেদিন নিহত হতভাগ্য মানুষগুলোর মধ্যে ১০৫ জনের পরিচয় এখনো মেলেনি। আদৌ আর মিলবে কি না- সে বিষয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। এই ১০৫ লাশের পরিচয় অশনাক্ত রেখেই ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল শেষ করা হয় ডিএনএ পরীক্ষা। রানা প্লাজা ধসের প্রায় এক বছরে অশনাক্ত ৩২২ জনের মধ্যে মোট ২০৬টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া ১১টি লাশের ক্ষেত্রে দুজনের ডিএনএর মিল পাওয়া যায়।