সুনামগঞ্জে বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসল পানির নিচে

বছরের এই সময়টাতে সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের মানুষ সাধারণত ব্যস্ত থাকেন পাকা ধান ঘরে তোলার কাজে। আর এ নিয়ে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে জেলার হাওরপাড়ের মানুষের জীবনে।
ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এতটুকু ফুরসত মেলে না। শুধু পুরুষরা নন, ধান তোলার কাজে হাত লাগান পরিবারের সব বয়সী সদস্য। এ সময়ে মাসের পুরোটাই তাদের কাটে হাওরপাড়ে। পুরুষরা ধান কেটে আনেন আর নারীসহ অন্য সদস্যরা সেই ধান রোদে শুকাতে দেন। দিন শেষে শুকানো ধান নিয়ে ঘরে তোলেন সবাই মিলে। সাধারণত বছরের পর বছর হাওরপাড়ে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে।
তবে এ বছর হাওরপাড়ের দৃশ্য অন্য রকম। উৎসব দূরের কথা, গত কয়েক দিনে হাসতেই ভুলে গেছেন হাওরপাড়ের মানুষ। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন কৃষকরা। কারণ, তাঁদের একমাত্র সম্বল স্বপ্নের সোনার ফসল এখন পানির নিচে।
কয়েকটি হাওরে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে মিলে কাজ করছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওরপাড়ে থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন। বালুর বস্তা, বাঁশ দিয়ে সহায়তা করছে প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
এ মুহূর্তে হাওরে পানির গভীরতা ১ থেকে ১২ ফুট। এ অবস্থায় সময়মতো ধান না তুলতে না পারলে কীভাবে সারা বছর কাটাবেন, এ নিয়েই দিন-রাত চিন্তা করছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
সদর উপজেলার ইছাগড়ি গ্রামের কৃষক আমীর আলীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তিনি জানান, তাঁর সব জমি পানির নিচে। নিজের চোখের সামনে সব ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। ধান কাঁচা থাকায় সেই ধান কেটে আনতেও পারেননি।
দরিয়াবাজ গ্রামের মমতাজ বেগম বলেন, ‘আগাম যা কিছু আধা পাকা ধান কেটে আনা হয়েছিল, সেগুলোও শুকানো যাচ্ছে না। স্তূপ করে রাখতে রাখতে ধানে নষ্ট হওয়ার পথে। এই ধান থেকে কোনো চালও বের হবে না। এখন সারা বছর সন্তানদের লেখাপড়া কীভাবে হবে আর নিজেরাই বা কীভাবে খেয়ে বাঁচব, বুঝে উঠতে পারছি না।’
জেলা প্রশাসন বাঁধ রক্ষায় স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে বাঁধ মেরামতে সহায়তা করলেও কৃষকদের আতঙ্ক কিছুতেই কমছে না। আর এ ক্ষতির জন্য বেড়িবাঁধ নির্মাণে বিলম্ব ও দুর্নীতি করায় পানি উন্নয়ন বোর্ডেকেই দায়ী করছেন অনেকেই।
হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলা বছরের বেশির ভাগ সময় পানির নিচে থাকে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে পানি কমে গেলে বোরো ধানের আবাদ করা হয়। এ বছর পুরো জেলায় দুই লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ফসল চাষাবাদ করা হয়। এই একটি মাত্র ফসল চাষের মাধ্যমেই সারা বছরের খরচ জোগান কৃষকরা।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ জানান, অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় কারণে মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। আবার অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে হাওরে পানি ঢোকায় ফসলহানির ঘটনা ঘটেছে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে ফসল তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আগাম বন্যায় বেশির ভাগ ফসলই নষ্ট হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ জেলার কৃষকরা এখন খুবই খারাপ আবস্থায় আছেন। তাঁদের সারা বছরের স্বপ্নের ফসল বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সে ফসল তুলতে পারলেন না। তাঁদের কথা চিন্তা করে সরকারের পক্ষে অনুদানের ঘোষণার কথাও দাবি করেন তিনি।
ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে যাঁদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা আফসার উদ্দিন বলেন, ‘মানুষ খামাখাই অভিযোগ তুলছে। মানুষ মানুষের কথা বলার বলবেই। আমরা আমাদের কাজ সঠিকভাবেই করেছি। এখন বৃষ্টিপাতে আর বন্যায় ফসল তলিয়ে গেলে কী করার আছে?’ তবে ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি নয় বলে দাবি করেন তিনি।
প্রায় একই রকম কথা বলেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাহিদুল হক। তিনি বলেন, ‘পানি বেশি থাকলেও ফসলের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। বেশির ভাগ ফসলই কৃষকরা কেটে নিয়েছেন।’ সব মিলিয়ে ১৫ হাজারের বেশি হেক্টরের ফসল ক্ষতি হবে না বলেও জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম জেলার একমাত্র ফসল রক্ষায় নানা পদক্ষেপের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘জেলায় একমাত্র বোরো ফসল রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমরা অর্থের কথা চিন্তা না করে নিজেদের উদ্যোগেই বালুর বস্তা, বাঁশ ইত্যাদি সরবরাহ করেছি। সেই সঙ্গে কৃষকদের জন্য চিড়া-গুড়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যাতে তাঁরা তাঁদের স্বপ্নের ফসলটা বাঁচাতে পারেন।’