বাকৃবিতে ৫ নকল থিসিসে নম্বর দিতে চাপ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ফার্ম স্ট্রাকচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে থিসিস (অভিসন্দর্ভ) নকলের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ করেছেন বিভাগের পরীক্ষা কমিটির প্রধান ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান আনোয়ার হোসেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উল্টো আনোয়ার হোসেনকে চাপ দিচ্ছে অভিযুক্তদের থিসিসে নম্বর দেওয়ার জন্য। অবশেষে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে আনোয়ার হোসেনকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আলী আকবর।
বিষয়টি নিয়ে আদালতে যান আনোয়ার হোসেন। আদালত আনোয়ার হোসেনের অব্যাহতি কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না মর্মে নোটিশ জারি করেছেন।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন জানান, বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের জুলাই-ডিসেম্বর, ২০১৫ সেশনের চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাঁচজন শিক্ষার্থী নকল করে থিসিস জমা দেয়। ‘ডিফেন্স পরীক্ষা’র সময় একটি এবং পরে আরো চারটি থিসিস নকল বলে ধরা পড়ে। স্নাতকোত্তর পরীক্ষা কমিটির প্রধান হিসেবে আনোয়ার হোসেন বিষয়টি কমিটির অন্য তিনজন সদস্য অধ্যাপক ড. মো. নুরুল হক, অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফ এবং অধ্যাপক মো. সিদ্দিকুর রহমানকে জানান। কিন্তু তাঁরা নকলের বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে এসব থিসিসে নম্বর দিয়ে পরীক্ষা কমিটির প্রধানের কাছে এক কপি এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে এক কপি জমা দেন। কিন্তু পরীক্ষা কমিটির প্রধান আনোয়ার হোসেন এসব থিসিসে নম্বর দেননি। কয়েকদফা বৈঠক করেও পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় বিভাগ।
কারণ ডিফেন্স কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. নুরুল হক, অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফ ও অধ্যাপক মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, ওই পাঁচ থিসিসে নম্বর দিয়ে পাস না করানো পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশ করা যাবে না।
পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ
নকল থিসিস জমা দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে, রাজিয়া সুলতানা, মাহমুদুল হাসান, আলমগীর হোসেন, সৌরভ সরকার ও নাজমীন আরার বিরুদ্ধে।
আনোয়ার হোসেন জানান, রাজিয়া সুলতানা আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত কারিগরী প্রতিবেদন অল্টারনেটিভস টু সলভেন্ট-বেসড পেইন্টস, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন থেকে প্রকাশিত, ন্যাশনাল রিপোর্ট অন লিড ইন এনামেল হাউজহোল্ড পেইন্টস ও ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিজে কোনো কাজ না করে থিসিস তৈরি করে জমা দেন। বিষয়টি রাজিয়া স্বীকারও করেছেন বলে জানিয়েছেন আনোয়ার হোসেন।
আনোয়ার হোসেন আরো জানান, অপর চার ছাত্রছাত্রী তাঁদের কো-সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. মো. খাইরুল ইসলামের চীনের গোয়াংডং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল সমাপ্ত করা প্রতিবেদনের চারটি অধ্যায় কিছুটা পরিবর্তন করে চারটি থিসিস তৈরি করে জমা দেন। অথচ ওই গবেষণা করার মতো গবেষণাগার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। বাংলাদেশের অন্য কোথাও আছে তাও জানা যায় না। থিসিসগুলো নিয়ে অধিকতর তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা কমিটিতে পাঠান পরীক্ষা কমিটির প্রধান আনোয়ার হোসেন। কিন্তু উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কোনো ব্যবস্থা নেননি।
উপরের বিষয়গুলো আনোয়ার হোসেন আদালতে করা রিটে উল্লেখ করেন।
নকল থিসিসে নম্বর দিতে চাপ
গত ২০ মার্চ ফার্ম স্ট্রাকচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ফলাফল চূড়ান্ত কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। আনোয়ার হোসেন জানান, সভায় নকল থিসিসে নম্বর দিয়ে পাস না করানোয় পরীক্ষা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. নুরুল হক তাঁকে (আনোয়ার হোসেন) অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন। নুরুল হক অন্য সদস্যদের নিয়ে শাসাতে শাসাতে কমিটির সভাস্থল ত্যাগ করেন। পরে ফোনে পরীক্ষা কমিটির প্রধানকে (আনোয়ার) বিভাগের অন্য শিক্ষক অধ্যাপক মো. আবদুর রশিদের নাম ব্যবহার করে হুমকি দিতে থাকেন। বিষয়টি জানিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার এবং নিরাপত্তা প্রদানের জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানান।
আনোয়ার হোসেন দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি কোতোয়ালি থানায় ড. মো. নুরুল হক এবং অধ্যাপক মো. আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর : ১২৩৭, ২৩ মার্চ ২০১৬) করেন।
গত ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মো. জসীমউদ্দীন খান ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেন পরীক্ষা কমিটির প্রধান আনোয়ার হোসেনকে ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টার কার্যালয় ডেকে পাঠান। আনোয়ার হোসেন জানান, সেখানেও থিসিসে নম্বর দিয়ে পাস করানোর জন্য চাপ দেওয়া হয় এবং ভয়ভীতি দেখানো হয়। কিন্তু আনোয়ার হোসেন এবারো তা করতে অস্বীকৃতি জানান।
গত ৩০ মার্চ রাতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষা কমিটির প্রধান আনোয়ার হোসেনকে বাদ দিয়ে তিনজন সদস্য মো. নুরুল হক, মো. আলী আশরাফ এবং মো. সিদ্দিকুর রহমান ফলাফল টেবুলেশন করেন।
আনোয়ার হোসেন জানান, রাত সাড়ে ৯টায় ফোনে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তাঁর কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। এবারো হুমকি, ভয়ভীতি দেখিয়ে ফলাফলে স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য তাঁর (আনোয়ার) ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। পরে বিষয়টি জানিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন জানান ড. হোসেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সে ব্যাপারেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
পরের দিন গত ৩১ মার্চ উপাচার্য ড. আলী আকবর নিজ বাসভবনে ডাকেন আনোয়ার হোসেনকে। সেখানেও উপাচার্য নকল থিসিসে নম্বর দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এবারো আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন আনোয়ার হোসেন।
গত ৩ এপ্রিল রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত আদেশে উপাচার্য ড. মো. আলী আকবর বিশেষ ক্ষমতাবলে আনোয়ার হোসেনকে বিভাগীয় প্রধান থেকে অব্যাহতি দেন। বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. আবদুর রশিদকে। আদেশটি দেওয়ার আগে কোনো ধরনের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়নি বা তদন্ত করা হয়নি।
বিষয়টি এখন আদালতে
অব্যাহতির আদেশ পাওয়ার পর ড. মো, আনোয়ার হোসেন ময়মনসিংহ সদর জর্জ কোর্টের সিভিল কোর্টে রিট করেন (মামলা নম্বর : ১৬৩/২০১৬)। গত ৬ মার্চ সহকারী সিনিয়র জজ বেগম সোনিয়া আহম্মেদ এক আদেশে বিভাগীয় প্রধান থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেন এবং উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আকবর, রেজিস্ট্রার ও অধ্যাপক মো. আবদুর রশিদকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন।
আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়ার পরও মো. আবদুর রশিদ বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। আগের বিভাগীয় প্রধানের নেমপ্লেট সরিয়ে ফেলে আবদুর রশিদ নিজের নাম লাগিয়েছেন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। বিভাগের ওয়েবসাইটেও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আবদুর রশিদের নামই দেখানো হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আবদুর রশিদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।’
এ বিষয়ে উপাচার্য আলী আকবরকে ফোন করা হলে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘ড. আনোয়ার নিরীক্ষার আগে আপত্তি না দিয়ে ভুল করেছেন। আদালতের নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া হবে।’