২৫০০ কোটি টাকার পাট, কাগজে আছে গুদামে নেই
রপ্তানির উদ্দেশ্যে গুদামে কাঁচাপাট দেখিয়ে খুলনার তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ‘প্লেজ ঋণ’ (গুদামজাত পাটের বিপরীতে ঋণ) নিয়েছেন তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান ও রপ্তানিকারক। কিন্তু বাস্তবে গুদামে কোনো পাট নেই।
বিষয়টি তিনটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানেন। অভিযোগ উঠেছে, নিজেরা ফেঁসে যাবেন এ আশঙ্কায় কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কর্মকর্তারা। তিন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো হচ্ছে সোনালী, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংক।
খুলনার পাট খাতে সোনালী, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই হচ্ছে ‘প্লেজ ঋণ’। আর এই প্লেজ ঋণের আড়াই হাজার কোটি টাকা আছে কেবল কাগজেকলমে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, পাট রপ্তানিতে সরকারের প্রণোদনা আর ব্যাংকঋণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অর্থ লোপাটের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা আর ব্যবসায়ীরা।
রাতারাতি রপ্তানিকারক
বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের খুলনা কার্যালয়ের সচিব মো. আবদুল হামিদ জানান, ২০০৮-২০০৯ সাল পর্যন্ত রপ্তানিকারকের সংখ্যা যেখানে ছিল ৫০ থেকে ৬০ জন, এখন এটা বেড়ে ৩০০ জনের ওপরে। এর বড় অংশ ব্যাংকের ঋণখেলাপি হয়ে আবার সদস্যপদ নবায়ন করছেন না।
কেবল ব্যাংকঋণের সুযোগ নিতে পাট আমদানিকারকের সংখ্যা এ হারে বেড়েছে বলে জানা যায়।
পাটের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ব্যবসা করছেন অশোক কুমার। তাঁর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নাম ‘এ কে জুট ট্রেডিং।’ প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯-২০১০ অর্থবছর পর্যন্ত ছিল দেশের সর্বোচ্চ কাঁচাপাট রপ্তানিকারক। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠান বাজারে নেই, পাটও কিনছে না। দৌলতপুর সোনালী ব্যাংক করপোরেট শাখায় অশোক কুমারের ঋণের পরিমাণ ৮০ কোটি টাকা। তিনি বর্তমানে ‘গীতাঞ্জলী এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন। গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ব্যাংকের টাকা না দিলেও ব্যাংক কিছুই বলছে না। বিধি মোতাবেক অশোককে ঋণখেলাপিও ঘোষণা করছে না।
জানা যায়, অশোক কুমার চলতি বছর উচ্চ মহলে তদবির করে আগের ঋণ পুরোটা ‘ব্লক’ করে নতুন করে ৩৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্লক করা টাকার কয়েকটি কিস্তিও তিনি এরই মধ্যে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নীরব। এ বিষয়ে ড. অশোক কুমারের বক্তব্য জানার জন্য তাঁর কার্যালয়ে একাধিবার গেলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। দৌলতপুর সোনালী ব্যাংকে তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে চাইলে অশোক কুমার এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
ড. অশোক কুমারের ভগ্নিপতি সনজিৎ কুমার দাস ‘ইস্টার্ন ট্রেডার্স’-এর মালিক। সোনালী ব্যাংকের দৌলতপুর করপোরেট শাখায় তাঁর সব মিলিয়ে ঋণ ছিল ৬৫ কোটি। তিনি গুদামে দুই হাজার ১০০ মণ পাট দেখিয়ে ঋণ নিয়েছিলেন, এসব বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা আদায়ের জন্য পত্রিকায় ‘নিলাম বিজ্ঞপ্তি’ও দেওয়া হয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিলামের দিন গুদামে কোনো পাট পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, সমঝোতার ভিত্তিতে সনজিৎ কুমার দাস উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। কেবল তাই নয়, ইস্টার্ন ট্রেডার্স ঋণখেলাপি হওয়ার আগেই নিজের স্ত্রীর মালিকানাধীন ‘জুট গার্ডেনে’র নামেও ২৫ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করিয়ে নেন সনজিৎ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সোনালী ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখা থেকে মোট ৫৬ জন পাট রপ্তানিকারককে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যার পুরোটাই এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ছয় মাস ধরে এসব খেলাপি ঋণ গ্রাহকদের গুদামের পাট নিলাম আহ্বান করা হলেও একটি গুদামের পাটও নিলামে বিক্রি করা যায়নি। কারণ ঘোষণা অনুযায়ী পাট ছিল না কোনো গুদামেই।
এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পরিতোষ কুমার তরুয়া জানান, একে জুট এবং সনজিৎ কুমার দাসের কাছ থেকে অর্থ আদায় করার জন্য আবার নতুন সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পাট ব্যবসায়ীরা উচ্চ মহলে তদবির করে ছয় বছরের সুদ ব্লক এবং কিস্তি করে নিয়ে এসেছেন। ফলে তারা ব্লক টাকার জন্য নতুন করে জামানত নিয়ে অর্থ আদায়ের সুযোগ দিচ্ছেন। জানেন তো, চোর ধরা পড়ে কিন্তু ডাকাত ধরা পড়ে না।’
খুলনা সোনালী ব্যাংক করপোরেট শাখার গত ছয়-সাত মাসে পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পাট নিলাম করতে চেয়েছেন। কিন্তু গুদামে পাট না থাকায় সে নিলাম বিক্রি হয়নি। এ ব্যাপারে এই শাখার প্রধান উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সমীর কুমার দেবনাথ ‘নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রদান ও পাট বিক্রি না হওয়ার কথা’ স্বীকার করে বলেন, ‘বর্তমানে গুদামের খোয়া যাওয়া পাটের সমমূল্যের জামানত আদায় করা হচ্ছে।’
তদারকি নেই, কারণ লোকবল নেই
সোনালী ব্যাংকের খুলনা জোনের মহাব্যবস্থাপক পরিতোষ কুমার তরুয়া বলেন, ‘এ খাতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে, কিন্তু সেই হারে লোকবল নেই তদারকির জন্য। যার সুযোগ নিয়ে পাট ব্যবসায়ীরা এসব ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।’
প্লেজ ঋণের বিধি বিধান হলো গুদামের চাবি জমা থাকবে ব্যাংকের কাছে। পাট বিক্রির পর সেই টাকা ব্যাংকের হিসাবে জমা হলে ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গুদামের পাট ছাড় করবেন।
এ বিষয়ে পরিতোষ কুমার তরুয়া বলেন, ‘যে গুদামে পাট রেখে প্লেজ ঋণ নেওয়া হয়, সেই গুদামের চাবি ও দায়িত্ব থাকে ব্যাংকের। অগ্রিম টাকা বা এলসি দিলেই ব্যাংকের গোডাউন-কিপার গুদাম খুলে দেয়।’
পরিতোষ কুমার জানান, প্লেজ ঋণের পাট গুদামে না থাকার জন্য ব্যাংকের ছয়-সাতজন ‘গোডাউন কিপার’কে সাময়িক বরখাস্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিস্ময় লেগেছে পাটঋণ পারিবারিককরণের বিষয়টি।’ তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘এফ আর জুট মালিকের শ্যালক, ভাই, চাচাতো ভাই, ভাইপো মিলে বর্তমানে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে রেজা জুটের মালিক সেলিম রেজা আগে টালি ক্লার্ক ছিলেন। বর্তমানে তাঁর ঋণ ৫০ কোটি টাকা, এটা কীভাবে হলো তা আমার জানা নেই।’
প্লেজ ঋণ বন্ধের সুপারিশ
বর্তমানে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোতে নতুন প্লেজঋণ প্রদান অঘোষিতভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংক খুলনা জোনের মহাব্যবস্থাপক পরিতোষ কুমার তরুয়া জানান, তিনি প্রধান কার্যালয়কে পাট খাতে প্লেজ ঋণ বন্ধ করার সুপারিশ করেছেন।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, পাট রপ্তানিতে মাত্র সাত শতাংশ সুদে স্বল্প মেয়াদে ‘প্যাকিং ক্যাশ ক্রেডিট’ (পিসিসি) ঋণ দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে এই টাকা পরিশোধের বিধান থাকলেও অনেকেই তা করেন না। ভুয়া ঋণপত্র (এলসি) দাখিল করে পাট রপ্তানিকারকরা এই পিসিসি ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর পার করে দেয়। একই অবস্থা প্লেজ ঋণের ক্ষেত্রেও। প্লেজ ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে গুদামে পাট আছে দেখানো হলেও বাস্তবে অনেক গুদামে হিসাবমতো পাট থাকে না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পাট রপ্তানিকারকরা প্রথমে নিজের নামে একটি ঋণ হিসাব খোলে। তারপর নিজের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামেও পৃথকভাবে আরো ঋণ নেয়। ফলে কোনো তদন্ত হলে এক গুদামের পাট বদল করে অন্য গুদামের পাট বলে চালাতে পারে।
এ ব্যাপারে ঢাকা ব্যাংকের খুলনার ভাইস প্রেসিডেন্ট আরিফ কামাল চৌধুরী বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্লেজ ঋণ হচ্ছে ময়লা কার্পেট দিয়ে ঢেকে রাখা। এভাবে কার্পেটের নিচে ময়লা ডেকে না রেখে জঞ্জাল পরিষ্কার করা দরকার।’
ঋণখেলাপিকে আবারও ঋণ
গত ৩১ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি দল জনতা ব্যাংকের ২৫০ কোটি টাকা জালিয়াতির জন্য ‘ঢাকা জুট ট্রেডিং হাউস’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. টিপু সুলতানকে খুলনা থেকে গ্রেপ্তার করে। জনতা ব্যাংকের ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ঘটনার পরও সব জেনে রূপালী ব্যাংক দৌলতপুর শাখা তাকেই ১১০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে রূপালী ব্যাংক দৌলতপুর শাখার এ জি এম মো. গোলাম মোরশেদ জানান, ‘ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ঋণ প্রদান করে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্ট (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) পর্যালোচনা করে প্রধান কার্যালয় ঋণ অনুমোদন করে।’
গোলাম মোরশেদ আরো বলেন, ‘ঢাকার জনতা ব্যাংকের লোকাল শাখা ঋণ দিযেছিল ঢাকা ট্রেডিং হাউসের মালিক মো. টিপু সুলতানকে। আর তারা ঋণ দিয়েছেন ঢাকা ট্রেডিং হাউস লিমিটেডকে, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. টিপু সুলতান।
এদিকে এই টিপু সুলতানের নামে বগুড়ায় প্রাইম ব্যাংকে ২৫০ কোটি টাকা এবং আরব-বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার ঋণ আছে বলে জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রূপালী ব্যাংক দৌলতপুর শাখা থেকে পাটের নামে ঋণ নিয়ে গাড়ি আর চিংড়িঘেরের ব্যবসা করছে ‘এস এস ট্রেডার্স’ ও ‘লাকি এন্টারপ্রাইজ’।
এ ব্যাপারে রূপালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা ডিজিএম অশোক কুমার সিংহ রায় প্রথমে বলেন, ‘জনসংযোগ বিভাগ ছাড়া কেউ কোনো কথা বলতে পারেন না। ‘পরে তিনি বলেন, ‘বোঝেন তো, সব। সবার সাথে মিলেমিশে চলতে হয়।’ ব্যাংকঋণ নিয়ে কোনো নিউজ না করে দৌলতপুর রূপালী ব্যাংকের এজিএমের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য এ প্রতিনিধিকে পরামর্শ দেন তিনি।