সবাইকে কাঁদিয়ে চিরনিদ্রায় ইউএনও রাশেদুল
মুখে সারাক্ষণ থাকত লাজুক হাসি। ছিলেন বিনয়ী, মেধাবী ও পরিশ্রমী। কথাগুলো নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামানের। নিজের সরকারি ফেসবুকে কথাগুলো বলছিলেন বাসচাপায় নিহত ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম প্রসঙ্গে।
সবাইকে কাঁদিয়ে সেই রাশেদুল ইসলাম এখন চিরনিদ্রায়। আজ বুধবার বেলা ১১টায় গাজীপুরের শ্রীপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এবং বাদ জোহর নিজ গ্রাম লোহাগাছ ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাদা-দাদির কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে ত্রিশালের দরিরামপুরে নজরুল একাডেমি মাঠে রাশেদুল ইসলামের প্রথম জানাজা হয়।
আজকের জানাজায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রফিকুল মোহামেদ, ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী, ত্রিশাল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, ভালুকার ইউএনও কামরুল আহসান তালুকদার, ময়মনসিংহ সদরের ইউএনও এস এম ফয়জুল হক, কাপাসিয়ার ইউএনও আনিসুর রহমান, শ্রীপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুম রেজাসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন।
এদিকে রাশেদুলের মৃত্যুর খবরে শ্রীপুরে তাঁর গ্রামের বাড়িসহ আশপাশের এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর লাশ দাফনের জন্য গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার লোহাগাছ গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হলে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক গতকাল তাঁর ফেসবুকে লিখেন, ‘প্রিয় রাশেদ, রাশেদ তোমার জন্য কাঁদছে সবাই, তোমার জন্য আজ পরম করুণাময়ের কাছে সমূহ প্রার্থনা...’
নিহতের পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার ত্রিশালের নুরুর দোকান এলাকায় চেইনম্যান সোহাগকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে জমি মাপতে গিয়েছিলেন ইউএনও রাশেদুল ইসলাম। সেখান থেকে ফেরার সময় তাঁরা যখন সড়কে ওঠেন তখন দ্রুতগামী পদ্মা গেইটলক নামের একটি বাস তাঁদের চাপা দেয়। এতে ইউএনও রাশেদুল ও চেইনম্যান সোহাগ আহত হন। তাঁদের উদ্ধার করে প্রথমে চুরখাই উইনারপাড় এলাকায় কমিউনিটি বেইজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সিবিএমসি) নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে দুজনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক রাশেদুলকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় পুলিশ বাসটিকে আটক করেছে। তবে পালিয়ে যাওয়ায় চালককে আটক করা সম্ভব হয়নি।
নিহত রাশেদুল ইসলামের ডাকনাম মুশরিফ। স্বজনেরা তাঁকে ওই নামেই ডাকেন। মুশরিফের ভাতিজা মাহবুবুর রহমান জানান, ২৭তম বিসিএস ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে মুশরিফ প্রথমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় যোগ দেন। পরে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দায়িত্ব পালন করেন। কয়েক মাস আগে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদে যোগ দেন। তিনি গিয়াস উদ্দিন মাস্টারের ছোট ছেলে।
‘দেশ মহামূল্যবান সম্পদ হারালো’
ইউএনও রাশেদুল ইসলাম মুশরিফের চাচাতো ভাই মো. রাহাত মণ্ডল আজ তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন, ‘...চোখের জলে বিদায় জানালাম প্রিয় মুশরিফ ভাইকে। কাগজে-কলমে যার নাম রাশেদুল ইসলাম। যিনি আমার থেকে প্রায় ১০ বছরের বড়, কিন্তু তাঁকে ডাকতাম তুমি তুমি করে। শুধু আমি না আমার চেয়ে যারা ১০ বছরের ছোট তারাও তাঁকে তুমি তুমি করে ডাকত। এ থেকেই বোঝা যায় সে সবার সাথে কতটা মিসুক ছিল। অত্যন্ত প্রাণবন্ত আর ভদ্র একটা চরিত্র। সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলা ছিল তার ব্যবহারের অন্যতম একটা দিক। জীবনে কখনো কারো সাথে রাগ করে কথা বলতে দেখিনি। ১৯৯৪ সালে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে শ্রীপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে সে। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে, নটর ডেম থেকে এইচএসসি তারপর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে। পরবর্তীতে ২৭তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে উত্তীর্ণ হয়। প্রথমে ঠাকুরগায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বেশ কিছুদিন, তারপর পদোন্নতি হয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালন করে। সর্বশেষ গত ২৮ জানুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি লাভ করে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস জীবনের উন্নতির এ পর্যায়ে এসে গতকাল (২৯ মার্চ) এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় (তাঁর কর্মরত ত্রিশাল উপজেলার বৈলর নামক স্থানে) মারা যান। মৃত্যুকালে সে স্ত্রী, বাবা, মা, দুই ভাই, এক বোন, আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছে।’
রাহাত মণ্ডল জানান, ‘...এত বেশি চোখের জল আর এত বেশি মানুষের হাহাকার সর্বশেষ কবে দেখেছি বা শুনেছি আমার খেয়াল নেই। তার জন্য হাজার হাজার মানুষের চোখের জল পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত তার জন্য সমবেদনা জানিয়েছে। আমি এখন বুঝতে পারছি আমরা কী হারিয়েছি। তুমি (রাশেদুল ইসলাম) ছিলে আমাদের বংশের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তুমি ছিলে আমাদের রত্ন আর দেশের মহামূল্যবান সম্পদ। তোমাকে হারিয়ে অনেক বড় ক্ষতের সৃষ্টি হলো যা কখনই সারার নয়। তোমাকে মিস করব সবসময়।...আল্লাহ তোমায় কবুল করুন। তোমাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।...’
শোকবার্তা : ইউএনও রাশেদুল ইসলামের মৃত্যুতে নরসিংদী ও বাগেরহাটের জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন মহল শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান তাঁর শোক বার্তায় বলেন, ‘২৯ মার্চ মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ক্যাডারের ২৭তম ব্যাচের সদস্য মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ সরকারি তদন্তে বিরোধপূর্ণ জমি পরিদর্শনে যাওয়ার সময় ত্রিশালের বৈলর এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এক মর্মান্তিত সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি... রাজিউন)।’
রাশেদুল ইসলাম নরসিংদী জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক বলেন, ‘রাশেদুল ইসলাম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) ক্যাডারের প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ, দক্ষ ও বিনয়ী এবং সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন কর্মকর্তা ছিলেন। সিভিল সার্ভিসের একজন নবীন কর্মকর্তা হয়েও সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সহকর্মীদের এবং এলাকার জনসাধারণের মনে স্থান করে নিয়েছেন। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁর মৃত্যুতে জেলা প্রশাসন, নরসিংদী গভীরভাবে শোকাহত। আমরা সকলে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’