ঝরনায় দূষণ, পাহাড়ে পানি এখন পণ্য

চট্টগ্রাম বিভাগের তিন পার্বত্য জেলার একটি বান্দরবান। এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের পানির অন্যতম উৎস ঝরনা। গত কয়েক দশকে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে বিনষ্ট হয়েছে বনাঞ্চল। এতে দূষিত হয়েছে প্রাকৃতিক ঝরনা। আর এ কারণে পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে সংকট তৈরি হয়েছে বিশুদ্ধ পানির। ফলে কিছু কিছু এলাকায় কিনে পানি পান করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। সম্প্রতি বান্দরবানের বিভিন্ন পাহাড়ি ঝিরি, ঝরনা ও সাঙ্গু নদী ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বান্দরবান-রুমা সড়কের আট কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত পাহাড়ি ঝরনা শৈলপ্রপাত। জীবন ধারনের পানির উৎসস্থল এই ঝিরিকে কেন্দ্র করেই পাহাড়ের বাসিন্দারা গড়ে তোলে আবাসস্থল। তারা এই ঝরনা থেকেই পান ও ব্যবহারের জন্য পানি সংগ্রহ করে আসছে।
শৈলপ্রপাত ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। তবে পর্যটকের ভিড়ে ছেয়ে আছে শৈলপ্রপাত। এই ঝিরিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ফারুক পাড়ার বাসিন্দারা জানায়, কয়েক প্রজন্ম ধরে তারা এই পাড়ায় বসবাস করছে। যদিও তারা বিশ্বাস করে না এই ঝিরির পানি কখনো শেষ হবে। তবে গত বর্ষায় তারা বান্দরবান শহর থেকে পানির বোতল কিনে চাহিদা মিটিয়েছে।
এ বিষয়ে কথা হয় পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এবং চার্চের সাবেক চেয়ারম্যান তয়ান কিন বমের সঙ্গে। তিনি বলেন, শৈলপ্রপাতের পানির সন্ধান পেয়ে বছর ৫০ আগে তাঁরা এই এলাকায় আবাস গড়ে তুলেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় পাড়ায় বসবাসরতরা শৈলপ্রপাতের ঝিরি থেকেই পানি সংগ্রহ করত। কিন্তু বর্তমানে নারীরা আর পানি সংগ্রহ ও গোসল করতে পারেন না। পাড়ায় পানি না থাকলে একান্ত বাধ্য হয়ে নারীরা রাতে ঝিরিতে গোসল করতে যায় এবং ব্যবহারের পানি সংগ্রহ করে।
কী কারণে পাড়ার নারীরা দিনে পানি সংগ্রহে যান না জানতে চাইলে বম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা শৈলপ্রপাতে ভ্রমণে আসেন। পাহাড়ি জীবনযাপনে সম্পর্কে ধারণা না থাকায় কতিপয় পর্যটক নারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। তাদের গোসলের ছবি ও ভিডিও করে। তাই লজ্জায় এখন আর পাড়ার নারীরা ঝিরিতে যায় না।
ওই অঞ্চলের কয়েকজন বাসিন্দা জানায়, গত কয়েক বছর আগে ঝিরি থেকে যে পরিমাণ পানি থাকত, এখন আর সেই পরিমাণ পানি নেই।
ঝিরির চারপাশ ঘুরে দেখা গেল, পর্যটককদের ছুড়ে ফেলা বোতল, চিপসের প্যাকেট, পলিথিন ইত্যাদি আবর্জনায় ভরে আছে ঝিরির বিভিন্ন অংশ। ঝিরির বিভিন্ন অংশে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া ড্রামে জমে থাকা পানিতেও দেখা মেলে আবর্জনা।
তবে আগত পর্যটকদের কয়েকজন জানায়, সরকারের অবহেলা ও সচেতনতার অভাবসহ পর্যটকদের সাবধান করার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এই ঝিরির এ পরিণতি হয়েছে। হয়তো ভবিষতে এই ঝিরি থেকে আর পানি বয়ে আসবে না।
পাহাড়ের বাসিন্দাদের ভাষ্য
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত বছর শহর থেকে পানি কিনে এনে জীবন ধারণ করেছে। এবার কী হবে তা অনুমান করে তারা বলছে, এবার হয়তো আরো ভয়াবহ অবস্থা হবে।
এ কিম বমকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, রোয়াংছড়ি থেকে এই এলাকায় পানির খোঁজ পেয়ে আসেন। তাঁদের পূর্ব পুরুষদের বিশ্বাস ছিল এই ঝিরির পানি কখনো শেষ হবে না। কিন্তু এখন ঝিরির অবস্থা খুবই করুণ।
ঝিরিতে পানি না থাকলে কী করবেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে বম বলেন, ‘মরে যাব।’
ঝরনা নিয়ে কষ্টের কথা তুলে ধরে বম বলেন, বর্তমানে বর্ষার সময়ে শৈলপ্রপাতের ঝরনার পানি ব্যবহার ও খাওয়ার জন্য উপযোগী থাকে না। কারণ ঝরনা এখন খুব দূষিত হয়ে পড়েছে। বর্ষার সময় উপর থেকে পানির সঙ্গে ময়লা আসে।
ফারুকপাড়ার লিয়ন ডিয়ন বম মাডি নামের এক তরুণ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নারীরা এখন পাড়ার ভেতর আনা ওয়াটার হাউজ থেকে গোসল করে। আগে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে গোসল করতাম। এখন যেতে পারি না। বর্ষা ছাড়া অন্য মৌসুমে পানিও থাকে না ঝরনায়।’
বম মাডি বলেন, ‘ঝিরির পাশে আগে বড় বড় গাছ ছিল। সব কেটে ফেলা হয়েছে। এগুলো পানি সংরক্ষণ করে রাখত। কিন্তু এখন ঝিরিতে পানি আর আগের মতো নেই। তা ছাড়া এখন আর ঝরনা থেকে আমরা পানি আনতে যেতে পারি না। মেয়েরা লজ্জা পায়। কারণ পর্যটকরা খারাপ আচরণ করে থাকে। পুরুষরাও গেলেও নারীরা যেতে পারে না। তাই ঝরনায় যাওয়া হয় না। সম্প্রতি এনজিওর দুটি প্রজেক্টের কারণে ওয়াটার হাউজ পাওয়া গেছে। তা শৈলপ্রপাত ঝিরির থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি এনে জমিয়ে রাখি।’
যা বলেন বিশেষজ্ঞরা
বান্দরবানের পাহাড়ি ঝিরি ও ঝরনার করুণ অবস্থা সম্পর্কে প্রাণ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আজকে বান্দরবানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির তামাক চাষ। এটি বান্দরবানের রুমা, আলি কদমসহ থানচিতে হচ্ছে। কারণ তামাক চাষগুলো হচ্ছে সাঙ্গু নদীর পাড় ঘেষে। এর ফলে সাঙ্গু নদীসহ আশপাশের যেসব ঝিরি-ঝরনা আছে, তা খুবই মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে। যেখানে এখনো রাস্তা-ঘাট, বহুজাতিক কোম্পানির তামাক চাষ হয়নি সেখানে এখনো অবশ্য ঝিরির পানির অবস্থা ভালো রয়েছে।
পাভেল পার্থ বলেন, ‘দেশের এমন একটি পার্বত্য অঞ্চলের মতো এতটাই জটিল ও সংবেদনশীল বাস্তুসংস্থানের মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানি তামাক ও ভুট্টা চাষ এবং একাশিয়া সেগুন বাগানকে সমর্থন করবে কি না, এটি রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ প্রকৃতি এ অঞ্চলের প্রাণ। আর এগুলো এই প্রকৃতির ঝরনা, নদী ও পাহাড়কে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। কারণ আমরা যদি বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে এই এলাকার নদী, ঝিরি, ঝরনা বা পাহাড়ের প্রকৃতির কাছে আসতে চাই ও দেখতে চাই তবে এই এলাকার প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে।’
পাভেল পার্থ বলেন, ‘আজকে পর্যটনের নামে অনেকেই শৈলপ্রপাত, রিজুকুঝর্ণা, নাফাকুমে চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের স্মরণে রাখা জরুরি যদি পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক বনভূমি কেটে একাশিয়া বাগান বা সেগুন গাছের মনোকালচার করা হয় তাহলে কখনোই পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক ঝিরি বা ঝরনা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।’
পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. আনিসুজ্জামান খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টির পানি পাহাড় শুষে নেয়। এক পর্যায়ে তা বিভিন্ন ঝরনার মাধ্যমে নদীতে আসে এবং পরে সাগরে যায়। এই যে প্রাকৃতিক জলবায়ুর চক্র। গত বছর বান্দরবানে অতিবৃষ্টি বা ফ্ল্যাশ ফ্লাড হয়েছে। এ ছাড়া খরার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে চির সবুজ বনের যে প্রাকৃতিক বিবর্তন তা ধ্বংস করে তামাক বা সেগুন গাছের মনোকালচার করা হচ্ছে।
আনিসুজ্জামান খান বলেন, ‘হাজার বছরের ৪০০ প্রজাতির প্রাকৃতিক উদ্ভিদ কেটে এক প্রজাতির উদ্ভিদ দিয়ে বনায়ন করছি। এর ফলে ফ্ল্যাশ ফ্লাড, পাহাড় ধস, খরা এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে।’
এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে বাংলাদেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। ইদানীং পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড় থেকে পাথর তুলে নেওয়া হচ্ছে। এতে হাজার বছরের বিবর্তনের ফলে পাহাড়ি এলাকায় যে পাথর গড়ে উঠেছে তা ধ্বংস হচ্ছে। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এমনকি চট্টগ্রাম শহরেও একটু বৃষ্টি হলেই ভূমিধস হচ্ছে।
ড. আনিসুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা এখন অনেক উন্নয়ন কাজ করছি যা পরিবেশবান্ধব নয়। অদূরদর্শিতার কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। তাই আমরা মনে করি পার্বত্য অঞ্চলের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় যদি মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়, তবেই রক্ষা করা সম্ভব হবে আমাদের পরিবেশ।’
স্থানীয় প্রশাসনের ভাষ্য
উল্লিখিত বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক (ডিসি) দিলিপ কুমার বণিক বলেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন পাড়ায় পানি সাপ্লাইয়ের (সরবরাহ) ব্যবস্থা নিচ্ছি। নীলাচলে বিশাল একটা প্ল্যান্ট করা হচ্ছে। অন্যান্য স্থান যেমন নদীর বা ঝিরির পারেও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বেশ কিছু প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। আশা করছি অচিরেই পানির সমস্যা নিরসন হবে।’
যত্রতত্র গাছকাটা ও পাথর উত্তোলনের বিষয়ে ডিসি বলেন, গাছ কাটাও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া যারাই পাথর তুলছে বা পাহাড় কাটছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পানি সরবরাহের জন্য সাড়ে ১৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদা না দিয়ে কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না। সহযোগিতা তো পাওয়া যায়ই না।
কারা অসহযোগিতা করেন জানতে চাইলে ইউনুস আলী বলেন, ‘লোকাল নেতা, হেড ম্যান, কারবারিসহ জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ থেকে সহযোগিতা পাইনি কখনো।’
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার পানির উৎস বিশেষ করে নদী, খাল, ছড়া, ঝিরি বা ঝরনাভিত্তিক কাজ করা খুবই সংবেদনশীল। কারণ সেখানকার পাহাড়ি মানুষের যে সভ্যতা গড়ে উঠেছে, তা পানি ভিত্তিক।’
পাহাড়ের ঝিরিতে অপরিকল্পিত পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা সম্পর্কে প্রধান বন সংরক্ষক বলেন, ‘নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সাথে আমরা সমন্বয় করে পার্বত্য এলাকায় পরিবেশ রক্ষায় আগ্রহী।’