উল্লাপাড়ায় ৬ দিনমজুরের বাড়িতে চলছে মাতম
জমা-জমি নেই। ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দিনমজুরি করে চলত তাঁদের পুরো সংসার। ট্রলার ডুবির ঘটনায় এমন ছয় ব্যক্তিকে হারিয়ে শোকের সাগরে ভাসছে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় থাকা তাঁদের পরিবার ও গ্রামের লোকজন।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে ছয় ব্যক্তির মরদেহ গ্রামে পৌঁছার পর গ্রাম ও এলাকাবাসী এক নজর দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শোকাহত ওই ছয়টি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনের বুকফাটা আর্তনাদে ওই এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
গতকাল বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের ধলেশ্বর নদীতে ট্রলার ডুবিতে উল্লাপাড়ার তিন গ্রামের দুই ভাইসহ ছয় দিনমজুর নিহত হন।
উল্লাপাড়ার উধুনিয়া ইউনিয়নের গারেশ্বর গ্রামের চারজন শ্রমিকের কবর খননকাজে নিয়োজিত জহির উদ্দিন (৬৫) ও আব্দুস সালাম (৪০) জানান, এ অঞ্চলের কোনো গ্রামেই এক সঙ্গে ছয় ব্যক্তির মৃত্যুর খবর তাঁদের জানা নেই। তাঁরা শোককে বুকে চেপে পাশাপাশি চারটি কবর খনন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ছয়টি পরিবার হতদরিদ্র ও ভূমিহীন। ট্রলার ডুবিতে নিহত ছয় ব্যক্তি ছিলেন পরিবারগুলোর একমাত্র উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি। তাঁদের মৃত্যুর ঘটনায় ওই পরিবারগুলো একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেছে।
গারেশ্বর গ্রামের আজিজুল হকের ছেলে নিহত শাহিন (২৮) দুই সন্তানের জনক। বাবা-মা, স্ত্রী রাশিদা খাতুন, পাঁচ বছরের মেয়ে মিম ও তিন বছরের ছেলে রাব্বীকে নিয়ে তাঁদের সংসার। মৃত্যুতে শাহিনের পরিবারের নেমে এসেছে ঘন অন্ধকার।
পাগল প্রায় স্ত্রী রাশিদা জানান, মৃত্যুর আগে শাহিন ফোন করে জেনে নেন ছেলেমেয়ের জন্য কী কী লাগবে। ছেলেমেয়ের জন্য কেনাকাটার কথা বলেছিলেন শাহিন। কিন্তু তাঁর আর কেনাকাটা করে বাড়িতে ফেরা হয়নি।
শাহিন লাশ হয়ে ফিরে হতবাক করে দিয়েছে পুরো পরিবার ও গ্রামবাসীকে। নিহত শাহিনের বাবা জানান, তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য কর্মক্ষম কোনো ব্যক্তি আর অবশিষ্ট নেই।
একই গ্রামের শহিদের ছেলে শরীফুল ইসলাম (১৮) ওই পরিবারের একমাত্র সন্তান। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারে চলছে আহাজারি। বুকফাটা আর্তনাদে মা সালেকা খাতুন বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন। বাবা শহিদের অচেতন দেহ ধরে আছে প্রতিবেশীরা।
৭০ বছরের বৃদ্ধা দাদি সাকিনা খাতুন নাতির শেষ গোসলের বড়ই পাতার পানি গরম করছেন। গ্রামের আত্মীয়স্বজন শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
গারেশ্বর গ্রামের মন্তাজ আলীর ছেলে আরেক নিহত নেজাব ( ৩৬) ও সুজাব (৩২) দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে পাথর হয়ে গেছেন বাবা মন্তাজ আলী। ভূমিহীন ওই পরিবারের নেজাবের স্ত্রী কদভানু ও তিন ছেলে করিম (৯), কবির (৭) ও নবীকে (৫) নিয়ে তাদের পরিবার। একমাত্র কর্মক্ষম নেজাবকে হারিয়ে তারা দিশেহারা।
অপর ভাই সুজাবও ভূমিহীন। তিনি নিঃসন্তান। সুজাবের স্ত্রী আনজিরা খাতুন স্বামীকে হারিয়ে পাগলপ্রায়।
উধুনিয়া ইউনিয়নের ফাজিলনগর গ্রামের চয়েনদির ছেলে মোতালেবও (৩০) ভূমিহীন ও হতদরিদ্র। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে গ্রামটিতে। শোকে কাতর পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়া যাচ্ছে না। তাদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
অপর দিকে, পাশের বাঙ্গালা ইউনিয়নের বানিয়াকৈর গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে সুজন (৩০) ছিল পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম সদস্য। তাঁর মুত্যুতে পুরো পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
সব মিলিয়ে উল্লাপাড়ার তিনটি গ্রামের মাটিকাটা ছয়জন শ্রমিকের মৃত্যুতের শোক শুধু তাঁদের পরিবারগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। গ্রামবাসী ও আশপাশের গ্রামগুলো থেকে শত শত মানুষও শোক সইতে না পেরে অঝোরে কেঁদেছে।
এদিকে উল্লাপাড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আকরাম আলী ও উধুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এম এ হামিদ বৃহস্পতিবার সকালে ওই গ্রামগুলোতে গিয়ে শোকাহত পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং নিহতের দাফন-কাফনের খবর নিয়েছেন।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) আকরাম আলী জানান, নিহত পরিবারগুলোকে কীভাবে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া যায় সে ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন পদক্ষেপ নেবে।
অপরদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন এরই মধ্যে নিহত প্রত্যেক পরিবারকে দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছে বলে জানা গেছে।