অবজ্ঞার কারণ জানতে চান ভাষাসৈনিক হেদায়েত
কিশোরগঞ্জ জেলার অত্যন্ত সুপরিচিত ভাষাসৈনিক আলহাজ হেদায়েত হোসেন গোলাপ। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সে সময় গঠিত কিশোরগঞ্জ মহকুমার সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
মহান ভাষা আন্দোলনের সময় হেদায়েত হোসেন গোলাপ ছিলেন স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এবং কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন এবং জেলা তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে চলাফেরায় প্রায় অক্ষম হয়ে পড়া ৮৩ বছর বয়সী হেদায়েত হোসেনের নিঃসঙ্গ দিন কাটে জেলা শহরের ফিসারি রোড এলাকায় নিজ বাড়িতে। বাসায় অবস্থান করা ছেলে বরকত হোসেন তাঁর দেখভাল করে থাকেন। তাঁর স্ত্রী স্কুলশিক্ষিকা জুলফি আরা হোসেন ফরিদা ও আরেক ছেলে শামীম গত বছর প্রায় কাছাকাছি সময়ে মৃত্যুবরণ করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরই জেলা প্রশাসন থেকে ভাষাসৈনিকের সম্মাননা পেয়ে আসছিলেন হেদায়েত হোসেন। কিন্তু গত তিন বছর বছর আগে হঠাৎ করেই অজ্ঞাত কারণে তাঁর নাম ভাষাসৈনিকের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভাষাসৈনিকের সম্মাননা থেকে।
প্রায়ই তিনি ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের কথা মনে হলে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। স্মৃতির ভেলায় চড়ে ফিরে যান অগ্নিঝরা সেই দিনগুলোতে। উত্তেজনায় কাঁপা কাঁপা গলায় বলে যান আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোর কথা। একে একে বলে যান জিন্নাহর ঘোষণা, ছাত্রদের মুখের ওপর প্রতিবাদ, রক্ত ভেজা ২১ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা নিয়ে পাকিস্তানিদের শোষণ, বৈষম্য ও ষড়যন্ত্রের কথা। এ ছাড়া আবেগমাখা উচ্চরণে প্রকাশ করে যান মাতৃভাষার প্রতি পরম মমতার কথা।
জীবন সায়াহ্নে এসে ভাষাসৈনিকের তালিকা থেকে বাদ পড়ায় তাঁর মনে কাজ করে তীব্র বেদনাবোধ। অব্যক্ত যন্ত্রণা ও ক্ষোভ নিয়ে ভাষাসৈনিক কেন বলেন, এর পেছনে কী কারণ তা না জানিয়েই আমাকে বাদ দেওয়া হলো কেন? কোনো কারণ থাকলে আমার কাছে কৈফিয়ত জানতে চাইল না কেন? জীবনের শেষ দিনগুলোতে এটাই কি আমার পাওনা ছিল?
ভাষাসৈনিকের তালিকা থেকে হেদায়েত হোসেনের নাম বাদ পড়ায় ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত ভাষা আন্দোলনে তাঁর সহযোদ্ধারাও। সহযোদ্ধারাও মনে করেন, এটা অন্যায় কাজ এবং এতে তাঁর প্রতি অবিচার করা করা হয়েছে, যা মোটেও কাম্য নয়। এ অবস্থায় হেদায়েত হোসেনকে পুনরায় ভাষাসৈনিকের সম্মাননা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁর স্বজন ও সহযোদ্ধারা।
সহযোদ্ধা ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ আ ফ ম শামছুল হুদা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভাষাসৈনিক হেদায়েত হোসেন ও আমি এক সাথেই ভাষা আন্দোলন করেছি। ভাষা আন্দোলনে উনার অবদান আছে। কিন্তু গত তিন বছর ধরে তাকে ভাষা সৈনিকের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। উনার প্রতি এ ধরনের আচরণ আমার খুব খারাপ লাগে। এই বয়সে হেদায়েত হোসেনকে এভাবে মনোপীড়া দেওয়া অত্যন্ত অনুচিত হয়েছে।’
হেদায়েত হোসেনের ছেলে বরকত হোসেন বলেন, ‘আমার ভাষাসৈনিক বাবা নিয়মিতভাবে জেলা প্রশাসনের সম্মাননা পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু তিন বছর ধরে উনাকে সম্মাননা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক জি এস এম জাফর উল্লাহ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মো. আক্তার জামিল ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু নাসের বেগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ কোনো কিছু বলতে রাজি হননি।