১৯ বছর পর অবসান হচ্ছে ‘ভারপ্রাপ্ত যুগের’
কিশোরগঞ্জে ১৯ বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। আজ শুক্রবার বিকেল ৩টায় এ সম্মেলনের নতুন কমিটি গঠিত হবে। ১৯৯৭ সালের পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর দায়িত্ব পালন করে আসছেন ভারপ্রাপ্ত নেতারা।
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহজাহান জানান, সম্মেলনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা যায়, উৎসবমুখর পরিবেশে সফলভাবে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম এ আফজাল বলেন, সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের মধ্যে তুমুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। দূর-দূরান্তের নেতাকর্মীরা এরই মধ্যে জেলা সদরে পৌঁছাতে শুরু করেছেন।
আজ প্রধান অতিথি হিসেবে সম্মেলন উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। প্রধান বক্তা হিসেবে থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। এ ছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মীর্জা আজম ও আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
এর আগে ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে সভাপতি, প্রয়াত এমপি এ কে এম শামছুল হক গোলাপ মিয়া সাধারণ সম্পাদক এবং প্রয়াত অ্যাডভোকেট জিন্নাতুল ইসলামকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে তিন বছর মেয়াদি ৬৩ সদস্যের জেলা কমিটি গঠন করা হয়। এর পর বেশ কয়েকবার সম্মেলনের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
দীর্ঘদিন পর সম্মেলনকে ঘিরে জেলা সদরসহ ১৩ উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। জেলা শহরের স্টেশন রোডের দলীয় কার্যালয়ে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। সম্মেলনের জন্য পুরাতন স্টেডিয়াম মাঠে বিশাল প্যান্ডেল নির্মিত হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে নৌকা আকৃতির বিরাট মঞ্চ। নেতৃবৃন্দকে স্বাগত ও সম্মেলনের শুভকামনা করে শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য তোরণ।
১৯৯৭ সালের নির্বাচন
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালে গঠিত কমিটির সভাপতি আবদুল হামিদ জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু মিয়াকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। বয়সের কারণে তিনি সাংগঠনিক কার্যক্রমে তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারেননি। গত বছরের ১ ডিসেম্বর ৭৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। এর পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান আরেক সহসভাপতি কামরুল আহসান শাহজাহান।
অন্যদিকে ১৯৯৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক গোলাপ মিয়ার মৃত্যু হলে কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহাবুদ্দিন ঠাকুরকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০০৭ সালের ১৪ অক্টোবর শাহাবুদ্দিন ঠাকুরও মারা যান। পরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম এ আফজালকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট জিন্নাতুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করায় এ পদটি বর্তমানে শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে আরো মারা যান জেলা কমিটির সহসভাপতি শাহাদাৎ হোসেন ও ফয়সল আলম।
সদস্যদের মধ্যে মৃত্যু হয় শ্যামল ঘোষ, আনোয়ার হোসেন, সোহরাব উদ্দিন ও হুমায়ুন কবির। বহিষ্কার হয়েছেন প্রচার সম্পাদক আনোয়ার কামাল ও সদস্য আবুল হাসেম। সব মিলিয়ে জেলা কমিটির হাতেগোনা ৮ থেকে ১০ জন নেতা কোনোরকমে দলটি চালিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁদের সহযোগিতা করছিলেন পদপদবিতে না থাকা অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাকর্মী।
সম্মেলন নিয়ে কিছু কথা
এদিকে, দেড় যুগ পরে সম্মেলন হওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির মূল পদপদবিতে জায়গা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন অপেক্ষাকৃত তরুণ সদস্যরা। তাঁদের দাবি, প্রবীণরা যুগের পর যুগ দল পরিচালনা করেছেন। এবার নতুনদের স্থান করে দেওয়া উচিত।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাকা উদ্দিন রাজন ও এনায়েত করিম অমি বলেন, ‘আজ থেকে ২০ বছর আগে ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হয়েছিলাম। ছাত্ররাজনীতি শেষ করে আশায় ছিলাম, মূল দলে কাজ করার সুযোগ পাব। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় দলে ঢুকতেই পারলাম না। আমাদের মতো ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অনেক নেতা আজ পর্যন্ত মূল দলের কোনো পদপদবি পাননি। আশা করছি, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এবার তরুণরা দলের নেতৃত্বে আসবে। সে সঙ্গে দূর হবে তাদের দীর্ঘদিনের হতাশা ও আক্ষেপ।’
তবে সম্মেলন কিংবা দল নিয়ে নেতাকর্মীরা নিজস্ব বলয়ে নানা কথা বললেও প্রকাশ্যে মুখ ফুটে কিছু বলছেন না। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের জেলা হওয়ায় তাঁদের খুব হিসাব-নিকাশ করে কথা বলছেন।
নেতাকর্মীরা কোনোভাবেই এ দুজনের বিরাগভাজন হতে চান না। কারণ সবার বিশ্বাস, সম্মেলনে এ দুই নেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহজাহান ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম এ আফজাল কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি হবে কি না, এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বলে নেতৃবৃন্দের ইচ্ছা অনুযায়ীই কমিটি গঠিত হবে বলে ইঙ্গিত করেছেন।
জেলার ১৪টি সাংগঠনিক থানার মধ্যে কুলিয়ারচর ও তাড়াইল ছাড়া আর কোনোটিতে সম্মেলন না হওয়ায় ১৯৯৭ সালের তালিকা ধরেই কাউন্সিলরদের বিষয়টি নির্ধারণ হবে, যা অনেকটাই জটিল ও দুরূহ হবে বলে মনে করছেন অনেক নেতা।
এ কারণেও নেতৃবৃন্দ কর্তৃক কমিটি ঘোষণার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করছেন তাঁরা। নেতাকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ দুটিকে নিয়ে। বিশেষ করে সাধারণ সম্পাদক পদটিকে নিয়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে তুমুল মাতামাতি। এ পদে রাষ্ট্রপতির ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক এমপি এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চাচাতো ভাই সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর নাম শোনা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ নিয়ে এ দুই নেতার সমর্থকরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জোরদার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। বলতে গেলে দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে এক প্রকার।
এ ব্যাপারে সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটু বলেন, 'সম্মেলন না হওয়ায় আমার কোনো দলীয় পরিচয় নেই। দীর্ঘদিন পর সম্মেলন হচ্ছে। কাউন্সিলে আমাকে যেন সাধারণ সম্পাদক করা হয়, সে দাবিই জানাব।’
সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক বলেন, ‘যদি কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের সুযোগ দেওয়া হয় এবং নেতাকর্মীরা যদি আমাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন, আমি দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত।’
তবে এ দুজনের বাইরেও দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা অ্যাডভোকেট এম এ আফজালকে ভারমুক্ত করে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা দেখেছেন কেউ কেউ।
অন্যদিকে সম্ভাব্য সভাপতি পদে জেলা পরিষদের প্রশাসক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহজাহান, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম এ আফজাল, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পাবলিক প্রসিকিউটর শাহ আজিজুল হকের নাম উচ্চারিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
সভাপতি প্রার্থী প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহজাহান, বর্তমান সহসভাপতি জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান জানান, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজাল এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পাবলিক প্রসিকিউটর শাহ আজিজুল হক জানান, সম্মেলনে তাঁরাও সভাপতির পদপ্রার্থী হবেন। তবে কাউন্সিলররা যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তাঁরা তা-ই মেনে নেবেন।
তবে নেতৃত্বপ্রত্যাশী সব নেতাই নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে একটি ভারসাম্য পূর্ণ গতিশীল কমিটি গঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।