বাবার কোলে ফিরে গেল শিশু বীথি
অবশেষে বাবার কোলে ফিরে গেছে ১০ বছরের শিশু বীথি। গত বছরের ১৯ আগস্ট বিচারিক হাকিম নুরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী নাতাশার সাতক্ষীরার বাসা থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় বীথিকে উদ্ধার করে পুলিশ। বীথির শরীরে ছিল ৩০টির মতো ক্ষতচিহ্ন।
গত সাড়ে চার মাস বীথির ঠিকানা ছিল বাগেরহাটের কিশোরী সংশোধন কেন্দ্রে। আজ বুধবার বীথিকে তুলে দেওয়া হয় তার বাবা গোলাম রসুল ওরফে রসুল আলীর কাছে।
বুধবার বীথিকে সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম মহিবুল হাসানের আদালতে হাজির করা হয়। পরে আদালতের নির্দশনা অনুযায়ী তাকে তুলে দেওয়া হয় তার বাবার হাতে। এর আগে শিশুটির বাবা মেয়েটিকে তার জিম্মায় দেওয়ার আবেদন করেন ।
গত ১৯ অগাস্ট শিশু বীথিকে সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলের টাউন বাজার ব্রিজের বিপরীতে আকরাম হোসেনের বাড়ির ভাড়াটিয়ার কক্ষ থেকে দেহে ৩০টি ছোট-বড় ক্ষত চিহ্ণসহ কংকালসার অবস্থায় উদ্ধার করা হয় । ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া বিচারিক হাকিম নুরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী নাতাশার বিরুদ্ধে অত্যাচার করার অভিযোগ উঠে। এদিন চরম নির্যাতনের মুখে ‘ পানি চাই, পানি খাব’ বলে ভর দুপুরে বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শিশু বীথির আহাজারি দেখে প্রতিবেশীরা পুলিশে খবর দেয়। কিন্তু বাড়ির দরজা বন্ধ করে রাখায় পুলিশ সমস্যায় পড়ে যায়। পরে সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা , সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার সাঈদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ আবদুল সাদী, নারী নেত্রী নাসরিন খান লিপি, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কোহিনুর ইসলাম ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তাকে ক্ষতসহ কংকালসার অবস্থায় উদ্ধার করে সাতক্ষীরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পর থেকে টানা ১৭ দিন সাতক্ষীরা হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে তাকে গত ৫ সেপ্টেম্বর পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাগেরহাট কিশোরী সংশোধন কেন্দ্রে।
বীথি অনেকখানি বদলে গেছে। দেহের নির্যাতনের চিহ্ণ অস্পষ্ট হয়ে গেছে। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে নির্যাতন ও অভুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হাড় জিরজিরে কংকালসার বীথি এখন এক সুস্থ সবল শিশু বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এদিকে সাতক্ষীরায় থাকাকালে বীথি চিকিৎসায় চার সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। বীথি পুলিশ ও সাংবাদিকদের সামনে তার ওপর নির্যাতনের নির্মম কাহিনী তুলে ধরে জানায় তাকে গরম খন্তি, রুটির তাওয়া, গরম পানির ছিটা, এমনকি ভাতের গরম ফেন দিয়ে নির্যাতন করা হতো। মারধর করা হতো। খেতে দেওয়া হতো না। এমনকি বাদ দেওয়া ছিন্ন পোশাকেই কাটাতে হতো তাকে। দিনের কয়েক ঘণ্টা যাবত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কোনো সুযোগ ছাড়াই আহার ও পানিবিহীন অবস্থায় বাড়ির ব্যালকনিতে অবরুদ্ধ করে রাখা হতো। বারণ ছিল কারো সাথে কথা বলারও। বাসার বাথরুম ব্যবহার করাও ছিল নিষেধ।
পুলিশ জানায়, বীথি প্রথম পর্যায়ে তার বাবা মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার বড় আমিনিয়ার গ্রামের গোলাম রসুল ওরফে রসুল আলীর সাথে যেতে সম্মত হয়নি। এজন্য তাকে বাগেরহাটে কিশোরী সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
এর আগে আতঙ্কিত বীথি নির্যাতনের অনেক কথা চেপে গিয়েছিল। তবে সুস্থ হয়ে সেই বীথি সাতক্ষীরা ত্যাগের আগে বলে যায় অনেক কথা।
বাবার কাছে না যাওয়ার কারণ হিসেবে বীথি জানিয়েছে ‘তার বাবার তিন বিয়ে। প্রথম স্ত্রী তার মাকে তার বাবা ঘুমের বড়ি খাইয়ে হত্যা করে। দ্বিতীয় স্ত্রী চলে গেছেন। এখন আছেন তৃতীয় স্ত্রী। আমি বাড়ি গেলে আমাকে আবারও নির্যাতন করা হতে পারে। আমি লেখাপড়া শিখতে চাই, কারো গৃহকর্মী হতে চাই না।’ বলছিল হাসিখুশী বীথি।
এদিকে বহু ক্ষতসহ বীথি উদ্ধারের পর ফুঁসে ওঠে সাতক্ষীরার নাগরিক সমাজ। তীব্র প্রতিবাদের ঝড় তুলে তারা এই নির্যাতনে সাথে সরাসরি জড়িত বিচারিক হাকিম নূরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী নাতাশাকে আটকের দাবি জানিয়ে কয়েকটি মানববন্ধন করে। এ নিয়ে গঠিত হয় একটি গণতদন্ত কমিশন। গণমাধ্যম ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দাবি ওঠে ম্যাজিস্ট্রেট নূরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী নাতাশাকে আটক করে শাস্তিদানের। এর পর পরই নুরুল ইসলামকে বিচারিক হাকিমের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে তিনি ও তাঁর স্ত্রী রাতের আঁধারে কাউকে কিছু না জানিয়েই বাড়ি থেকে হালকা তল্পিতল্পা নিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। এর কিছুদিন পর বিচারিক হাকিম নূরুল ইসলাম সাতক্ষীরায় তাঁর স্বপদে ফিরে আসেন।
এদিকে বীথির বাবা গোলাম রসুল গত ১ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরায় এসে সাতক্ষীরা থানায় সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিম ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি নির্যাতনের মামলার আবেদন জমা দেন। পুলিশ মামলা না নিয়ে আবেদনটি ফেরত দেয়। মামলা না নেওয়া এবং মেয়ে বীথি তাঁর কাছে আসতে রাজি না হওয়ায় দরিদ্র ডিম ব্যবসায়ী গোলাম রসুল মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে যান গত ২ সেপ্টেম্বর। আর বীথির নতুন ঠিকানা হয় বাগেরহাট কিশোরী সংশোধন কেন্দ্র। বিচারিক হাকিম ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে এখনো সোচ্চার রয়েছে সাতক্ষীরার মানুষ।
জানা গেছে বিচারিক হাকিম নূরুল ইসলাম চুয়াডাঙ্গা জেলার আলম ডাঙ্গার বাদুমাঝি গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর স্ত্রী নাতাশাও একই এলাকার বাসিন্দা।