নৌকায় পরাস্ত লাঙ্গল ও ধানের শীষ

সারা দেশে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীক নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিল রাজনৈতিক দলগুলো। বুধবার সারা দেশে ২৩৪টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণ করা হয়।
সর্বশেষ ২২৭টি পৌরসভা নির্বাচনের প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, নৌকা মার্কা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছেন। ১৭৭টি পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। নির্বাচনের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে আওয়ামী লীগের সাতজন প্রার্থী।
স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের ১৮ জন বিদ্রোহী মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন। বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন মাত্র একটি পৌরসভায়।
অন্যদিকে, সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি ২২টি পৌরসভায় জয়ী হয়েছে। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন একজন। স্বতন্ত্র পরিচয়ে দুটি পৌরসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। এর বাইরে ছয়জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
বিভাগওয়ারি ফল
ঢাকা বিভাগে মোট ৪১ পৌরসভার মধ্যে ৩৩টিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি একটিতে, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চারটি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী একটিতে জয়ী হয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ৩৭টি পৌরসভায় ৩৪টিতেই জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী একটি করে পৌরসভায় জয়ী হয়েছে। এ বিভাগে একটি পৌরসভায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।
খুলনা বিভাগে মোট ২৯টি পৌরসভায় ২২টিতে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুটি, তিনটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র দুজন জয়ী হয়েছেন।
ময়মনসিংহে মোট ২৪টি পৌরসভায় ১৯টিতে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুটি ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী তিনটিতে জয়ী হয়েছে।
বরিশালে মোট ১৭টি পৌরসভায় ১৫টিতে আওয়ামী লীগ ও একটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছে। এ বিভাগে একটি পৌরসভায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।
সিলেটে মোট ১৬টি পৌরসভায় ১০টিতে আওয়ামী লীগ, তিনটিতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তিনটিতে জয়ী হয়েছে।
রাজশাহীতে মোট ৫০টি পৌরসভায় ৩৪টিতে আওয়ামী লীগ, ১০টিতে বিএনপি, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা তিনটিতে, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী একটিতে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দুটিতে জয়ী হন।
রংপুরে মোট ২০টি পৌরসভায় ১০টিতে আওয়ামী লীগ, তিনটিতে বিএনপি, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী একটিতে ও জাতীয় পার্টি একটিতে জয়ী হয়েছে। এ বিভাগে দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
তিনটি পৌরসভায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।
সহিংসতাসহ বিভিন্ন কারণে সাতটি পৌরসভায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। এগুলো হলো বরগুনার বেতাগী, নোয়াখালীর চৌমুহনী, নীলফামারীর সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রামের উলিপুর, নরসিংদীর মাধবদী ও মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভা।
গতকাল অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল, অবৈধভাবে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটেছে।
ভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনের দিন ১৯ জেলার ৩৩ মেয়র পদপ্রার্থী নির্বাচন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন। পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নীলফামারীর সৈয়দপুর, জয়পুরহাট, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, লক্ষ্ণীপুরের রামগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঢাকার অদূরে সাভারের মতো এলাকায় নির্বাচনের সময় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, উচ্ছৃঙ্খলা, জাল ভোট দেওয়ার ঘটনা দেখা যায়।
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ভোটকেন্দ্রের সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হয়েছেন। সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর উপস্থিতিতে হামলায় চার সাংবাদিক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বরগুনায় সহিংসতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীসহ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ১১ জন। আর চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার ঘটে।
এদিকে, নির্বাচনের দিন সকালেই প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে যায়। সেখানে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কিছু কিছু পৌরসভায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের লোকজন বাড়াবাড়ি করছে। এতে সহিংসতার সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কিছু জায়গায় বাড়াবাড়ি ছাড়া সুষ্ঠু, আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ চলছে।’
এ দিন সকালে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুকের নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে আসে। সেখানে সাংবাদিকদের কাছে ওসমান ফারুক বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমাদের যে পর্যবেক্ষণ, তাতে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ৬০টির বেশি কেন্দ্র দখল করে নিয়েছে। ওই সব ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা ভোট দিতে যেতে পারছেন না।’ তবে বিএনপি পৌরসভা নির্বাচন বর্জন করবে না বলে পরিষ্কার করে জানিয়ে দেন ওসমান ফারুক।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনে এসে ভোটকেন্দ্র দখল, এজেন্টদের মারধর এবং জালভোট দেওয়ার অভিযোগ করেন জাতীয় পার্টির নেতারা। এ ব্যাপারে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত একটি চিঠি কমিশনকে দেওয়া হয়। কমিশনে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইদুল রহমান টেপা দাবী করেন, তাঁদের কয়েকজন প্রার্থীসহ ২৫টি পৌরসভার ১৭৬টি কেন্দ্রে এজেন্টদের মারধর ও জাল ভোট দেওয়া হয়েছে।
তবে নির্বাচনের পরিবেশে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ। দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ দাবি করেন, অতীতের তুলনায় এবারের পৌর নির্বাচন অনেক ভালো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
তবে বিএনপির পক্ষ থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের নীলনকশায় নির্বাচন কমিশন পৌর নির্বাচনের মাধ্যমে জাতিকে আরো প্রহসনের নির্বাচন উপহার দিয়েছে।