বেরিয়ে আসছে পাবনার সেই ওসির নানা তথ্য
গণধর্ষণের শিকার এক গৃহবধূকে থানা চত্বরে এক ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের ঘটনায় পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবাইদুল হককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর পরই তাঁর নানা অপকর্মের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
মাদক ব্যবসায়ী ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ওবায়দুল হকের ছিল দহরম-মহরম সম্পর্ক। তাঁদের যোগসাজসে মামলার নামে থানায় সালিশ বাণিজ্যই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা থেকেও আসামিদের নাম বাদ দিয়ে নিরীহ ব্যক্তিদের জড়ানোসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে তাঁর বিরুদ্ধে। একাধিক মামলার আসামিদের থানায় ধরে এনে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ারও অভিযোগ ছিল ওসি ওবাইদুল হকের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সূত্রে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ রাসেল আলী মাসুদ বলেন, ‘ওসি ওবাইদুল হক সম্প্রতি পাবনার ভাড়ারা ইউনিয়নের চাঞ্চল্যকর জাসদ নেতা লস্কর খানসহ ডাবল মার্ডার মামলার অন্যতম প্রধান আসামিকে ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে এজাহার থেকে নাম বাদ দিয়েছেন। বিষয়টি পাবনায় ওপেন সিক্রেট হলেও কেউ তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায়নি।’
রাসেল আলী মাসুদ আরো বলেন, ‘কারণে অকারণে ওসি ওবাইদুল আমাদের সঙ্গেও চরম দুর্ব্যবহার করতেন।’
আওয়ামী লীগের ওই নেতা আরো বলেন, ‘চরঘোষপুরে চাঞ্চল্যকর রফিকুল ইসলাম রফি মণ্ডল হত্যা মামলার বাদী ও তাঁর ভাই কামরুল ইসলামের কাছে থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে ওসি মামলা নথিভুক্ত করেন।’
এ ছাড়া বৈশাখী টিভি ও দৈনিক সংবাদের পাবনার স্টাফ রিপোর্টার প্রবীন সাংবাদিক হাবিবুর রহমান স্বপন বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালীন পুলিশের গাফিলতি ও ওই ওসির মাদক কারবারীদের সঙ্গে সখ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করি। এজন্য গত বছরের ১৩ অক্টোবর আমার ওপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালানো হয়। এর আগে সাঁথিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি আমার বাড়িতে গিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে খবর না লিখতে হুমকি দেন। এর পরও খবর প্রকাশ করায় ১৩ অক্টোবর রাতে আমার ওপর হামলা চালানো হয়। এ ঘটনার সিসি টিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে হুমকিদাতা শফিকুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। আমি ওসি ওবাইদুল হকের কাছে এ নিয়ে বার বার অভিযোগ করি। কিন্তু ওসি আমার অভিযোগের তোয়াক্কা না করে ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেন। সম্প্রতি থানায় বিয়ের ঘটনায় ওসি বেকায়দায় পড়লে তাঁকে বাঁচাতে শফিকুল আবারো সক্রিয় হন। তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের মোবাইলে ফোন করে ওসির বিপক্ষে সংবাদ না করতে তদবির করতে থাকেন। এতেই প্রমাণ হয় যে, অপরাধীদের সঙ্গে ওসির কতটা সখ্য রয়েছে। এ ছাড়া অন্তত এক ডজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী ওসি ওবাইদুলকে বাঁচাতে ফেসবুকসহ বিভিন্ন স্থানে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের আগস্ট মাসে পৌর এলাকার পাটকিয়াবাড়ি থেকে কাইল্লা শাহিন নামের এক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে আদালতে না পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকায় ছেড়ে দেন ওসি ওবাইদুল। তাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া মানুষের দৃষ্টি এড়াতে ওসি ওবাইদুল হক থানা চত্বরে মসজিদ উন্নয়নের কাজ করেন। এ কাজে থানাপাড়া এলাকার কায়কোবাদ মানিক নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষের কাছ থেকে বিপুল অংকের চাঁদা সংগ্রহ করেন। কিন্তু মসজিদ সংস্কারে সামান্য কিছু টাকা খরচ করে বাকি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেন।
এদিকে গত বছরের ২৮ আগস্ট রাতে পাবনার নারী সাংবাদিক সুর্বণা আক্তার নদীকে তাঁর বাড়ির সামনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ মামলার আসামি পাবনার শিমলা হাসপাতালের মালিক আবুল হোসেন ও তাঁর ছেলে রাজিব। তাঁদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা উৎকোচ নিয়ে মামলাটি নিষ্ক্রিয় করে ফেলেন বলে অভিযোগ করেন নিহত সাংবাদিক নদীর মা মর্জিনা খাতুন।
জেলা প্রশাসনের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ওসি ওবাইদুল নিজে আবুলের টাকার কাছে এই মামলাকে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন মামলাটি কী অবস্থায় আছে তা জানেন না নদীর পরিবার। এদিকে ওসি ওবাইদুল হক আসামি আবুল হোসেনের কাছ থেকে থানার জন্য ৪২ ইঞ্চি টিভি ও দেড় লাখ টাকা দামের দুইসেট সোফা উপহার নেন।’
এ ব্যাপারে পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ইবনে মিজান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এসব বিষয়ে বেশ কয়েকটি কমিটি তদন্ত কাজ করছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’