এসব তো রাস্তার কথা
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন আবেদনের শুনানিকালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেছেন, সরকার বলেছে, খালেদা জিয়ার মামলায় তারা কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। জামিন হলে কোনো অসুবিধা নেই। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের থাকতে হবে কেন?
জবাবে আদালত বলেন, ‘এসব তো রাস্তার কথা। তারা তো আদালতে এসে বলেনি। অ্যাটর্নি জেনারেল আসুক, এরপর শুনানি হবে।’
আজ মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানিকালে আদালত এসব মন্তব্য করেন।
আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন শুনানি করেন। এ সময় বিএনপির অপর আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, দুদকের পক্ষে খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের শুনানির কথা থাকলেও তিনি সময় চেয়ে অনুপস্থিত ছিলেন।
এ সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শিমুল বিশ্বাস উপস্থিত ছিলেন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা ছিল আজ বেলা ১১টায়। সে হিসেবে বেলা ১১টায় প্রথম দফায় শুনানি শুরু হয়।
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, আমরা এ বিষয়ে শুনানি করতে চাই।’
এ সময় সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইয়াসমিন বীথি বলেন, ‘এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অংশ নেবেন। তিনি অন্য মামলায় ব্যস্ত রয়েছেন। তাই দুপুরের পর শুনানি রাখা হোক।’
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত সরকার বলেছে, খালেদা জিয়ার মামলায় তারা কোনো হস্তক্ষেপ করছে না। জামিন হলে কোনো অসুবিধা নেই। তাহলে অ্যাটর্নি জেনারেলের থাকতে হবে কেন?’
এ সময় আদালত বলেন, ‘এসব তো রাস্তার কথা। তারা তো আদালতে এসে বলেনি। অ্যাটর্নি জেনারেল আসুক, এরপর শুনানি।’
এরপর দুপুর ২টায় শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে আবার শুনানি শুরু হয়। শুনানিকালে প্রথমে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, আমরা শর্ট সাবমিশন রাখব। খালেদা জিয়া এ মুহূর্তে গুরুতর অসুস্থ। এ মামলায় তাঁকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে। তিনি তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁকে এ মামলায় আসামি করে সাজা দেওয়া হয়। আমরা সাজার বিরুদ্ধে (কথা বলব না) যাব না। শুধু জামিনের বিষয়ে কথা বলব।’
এ সময় আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মামলার অভিযোগ গঠন এবং এজাহার উপস্থাপন করেন।
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মামলার বাদী এজাহারে আসামি হিসেবে খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করেননি। তিনি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে টাকা আত্মসাৎ করেছেন—এ ধরনের কোনো কথাও বলেননি। কিন্তু এ মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগ গঠনের সময় খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আদালত তা গ্রহণ করে দুদক আইনের সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে দিলেন। কী চার্জ হলো, কী সাক্ষ্য হলো আর কী জাজমেন্ট হলো? যেখানে বাদী নিজে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া টাকা আত্মসাৎ করেননি।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘আপনারা চার্জ গঠন এবং সাক্ষ্য বিষয়ে আসেননি কেন?’
জবাবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ছিল রেজিস্ট্রিকৃত ট্রাস্ট। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। ট্রাস্টের টাকা ট্রাস্টে আছে। ডা. ফারজানা নামের একজন ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক মামলা করল। অথচ তাঁকে সাক্ষী হিসেবে দেখানো হয়নি। এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করা হয়েছে। পার্টির লোকজন এখানে টাকা জমা দিয়ে থাকে। আমরা এসব আপিল শুনানিকালে বলব। তবে কয়েকটি যুক্তিতে জামিন চাই।’
‘তা হলো খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে প্রায় অচল হয়ে গেছেন। তাঁর ডায়াবেটিস ১৬-এর নিচে আসছে না। বেশির ভাগ সময় ২২ থেকে ২৭ পর্যন্ত থাকে। এ ছাড়া মামলার বাদী এবং প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা নিজেই বলেছেন, খালেদা জিয়া কোনোরূপ টাকা আত্মসাৎ করেননি। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারও করেননি। এর আগে সাত বছর সাজাপ্রাপ্ত অনেক আসামিকে আপনারা জামিন দিয়েছেন। এ ধরনের কয়েকটি মামলার রেফারেন্স দিলাম। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তাররা চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা বলছেন, এখানে খালেদা জিয়ার পর্যাপ্ত চিকিৎসা সম্ভব নয়। আমরা খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলছি, তাঁকে যেন জামিন দেওয়া হয়।’
এ সময় জয়নুল আবেদীন আরো বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত, সরকারও মিডিয়ার সামনে অনেকবার বলেছে, খালেদা জিয়াকে জামিন দিলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা আদালতে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।’
এ সময় আদালত কক্ষে আইনজীবীদের মধ্যে সবাই হেসে ওঠেন।
এরপর খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ট্রাস্টের টাকা ট্রাস্টে রয়েছে। আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। একজন অফিসার্স অব দ্য কোর্ট হিসেবে আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন। এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার বাঁ হাত বিকল হয়ে বাঁকা হয়ে গেছে। একটি ৭৫ বছরের বৃদ্ধাকে এ বয়সে কারাগারে রাখা অমানবিক। তিনি নিজে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। বসতে পারেন না। তাঁকে ধরে ধরে বসাতে হয়। বাথরুমে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালের ছোট্ট একটি সিটে তাঁকে রাখা হয়েছে। তিনি নড়াচড়া করতে পারেন না। আদালত মানবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাঁকে জামিন দিতে পারেন।’
এ সময় আদালতের দুই বিচারক হেসে ওঠেন।
এরপর খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এ মামলায় খালেদা জিয়াকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত খালেদা জিয়ার শরীরের এমন অবস্থা হয়েছে, তিনি কারাগারেই মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আদালতের প্রতি আমাদের সম্মান রয়েছে। অথচ সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি আদালতের ওপর চাপ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে আদালতের ওপর সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করছে না।’
এ বক্তব্যের সমর্থনে খন্দকার মাহবুব হোসেন একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ আদালতের কাছে উপস্থাপন করেন।
এরপর দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান আদালতে দাঁড়িয়ে মামলার সাজার নথি পড়া শুরু করেন। তিনি বলেন, দুদক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে খালেদা জিয়ার সাজা দেওয়া হয়েছে। জামিন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে বলা হয়েছে, সরকারের প্রধান হলেন একজন পাবলিক সার্ভেন্ট। তিনি এ পদে থেকে ট্রাস্ট গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের ঠিকানায় ট্রাস্টের ঠিকানা ব্যবহার করতে পারেন না।
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা পেছন থেকে আদালতের কাছে বলতে থাকেন, দুদকের আইনজীবী একজন অভিজ্ঞ লোক। কিন্তু তিনি জামিনের শুনানিতে এসে মামলার আপিলের শুনানি করছেন। এ মুহূর্তে এসব কথা বলে সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই না। এরপর দুদকের আইনজীবী শুনানি শেষ করেন।
এরপর পুনরায় খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, বিজ্ঞ আদালত খালেদা জিয়া ফৌজদারি কোনো অপরাধ করেননি। এরপরও তাঁকে ধরে নিয়ে এসে সাজা দেওয়া হলো। তিনি সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় আদালত বলেন, শেখ হাসিনা আর ওবায়দুল কাদের তো একই মাপের না। খালেদা জিয়া আর মসিউর রহমান একই হতে পারে না। সেই হিসেবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
এরপর আগামীকাল বুধবার দুপুর ২টা পর্যন্ত এ মামলার শুনানি মুলতবি করা হয়। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষ তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবে।
আদালত এর আগে নথি তলব করেছিলেন। নথি আসার পর আদালত জামিন শুনানির জন্য ৩০ জুলাই দিন নির্ধারণ করেছিলেন।
গত ২০ জুন বিচারিক আদালত থেকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার নথি বিচারিক আদালত থেকে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আসে।
গত ৩০ এপ্রিল আপিল শুনানির জন্য হাইকোর্টের এ বেঞ্চ খালেদা জিয়ার করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। এ ছাড়া বিচারিক আদালতের রায়ের নথি দুই মাসের মধ্যে হাইকোর্টে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণা করেন পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৫-এর বিচারক ড. মো. আকতারুজ্জামান। রায়ে খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। এই মামলায় অপর তিন আসামিকেও সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া আপিল করলে ৩০ এপ্রিল তা শুনানির জন্য গ্রহণ করে অর্থদণ্ড স্থগিত করেন হাইকোর্ট। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে ছিলেন খালেদা জিয়া। বর্তমানে তিনি কারা হেফাজতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন।