ভৈরবে ভুল চিকিৎসায় ব্যবসায়ী মৃত্যুর বিচার দাবিতে প্রতিবাদ সভা
কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ট্রমা অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় পোলট্রি ব্যবসায়ী জুয়েল মিয়ার মৃত্যুর বিচার দাবিতে প্রতিবাদ সভা হয়েছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় শহরের চণ্ডীবের পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় ওই প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ অংশ নিয়ে হত্যার প্রতিবাদ জানান। সভায় নিহত জুয়েল হত্যার বিচার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত পোস্টার প্রদর্শনসহ ক্ষোভ প্রকাশ করে মুহুর্মুহু স্লোগান দেয় অংশগ্রহণকারী জনতা।
পৌর কাউন্সিলর আওলাদ হোসেন সওদাগরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় বক্তারা জুয়েল হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার, জুয়েলের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মামলা প্রত্যাহার, হাসপাতালটি স্থায়ীভাবে সিলগালা করে দেওয়া এবং স্থানীয় সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে নজরদারির আওতায় আনার আহ্বান জানান। অন্যথায় রাজপথ অবরোধসহ ভৈরবকে অচল করে দেওয়ার ঘোষণা দেন তারা।
প্রতিবাদ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. সায়দুল্লাহ মিয়া নিন্দা ও ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কত বড় অমানবিক ও নির্দয়; তাদের ভুল চিকিৎসায় একটা তরজাতা প্রাণ অকালে ঝরে গেল। অল্প বয়সে বৈধব্য বরণ করতে হলো একজন নারীকে। শিশুকালেই এতিম হলো দুটি অবুঝ বাচ্চা। এসব অপরাধকে ঢাকতে উল্টো শোকাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা করল আদালতে।
জুয়েল হত্যাকাণ্ড এবং মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মাশুল দিতে হবে বলে উল্লেখ করে উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, আমরা সমস্ত ভৈরববাসী জুয়েলের পরিবারের পাশে আছি। দেখে নেব, কারা তাদের বিরুদ্ধে লড়তে আসে।
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা সুলায়মান বলেন, জুয়েলের পরিবারকে ভৈরববাসী বুক দিয়ে আগলে রাখবে। আর অপরাধীরা যত শক্তিশালী আর কৌশলীই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় এনে সুবিচারের মুখোমুখি করা হবে। তিনি এ সময় পুলিশ প্রশাসনকে এ বিষয়ে আরো তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান।
সভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাজি সেলিম খান বলেন, জুয়েল হত্যার পর এলাকাবাসীর যে তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে, অপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত যেন সেটি অব্যাহত থাকে। কোনো কারণে যেন মিলিয়ে না যায়। কারণ অনেক সময় জনতার পিছুটানে অপরাধীরা পার পেয়ে যায় এবং নতুন অপরাধে উৎসাহিত হয়।
কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ট্রমা অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় পোলট্রি ব্যবসায়ী জুয়েল মিয়ার মৃত্যুর বিচার দাবিতে শহরের চণ্ডীবের পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। ছবি : এনটিভি
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সেন্টু বলেন, জুয়েল হত্যাকারী চিকিৎসক ডা. কামরুজ্জামান আজাদসহ অন্যান্য অপরাধী এবং জুয়েলের পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার বাদী হাসপাতালের পরিচালক শফিকের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তিনি এ সময় মিথ্যা মামলার বাদী শফিককে তিন দিনের মধ্যে মামলা প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান। নতুবা জনতাকে সঙ্গে নিয়ে এর যথাযথ জবাব দেওয়া হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি দেন।
সভায় ভৈরব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আলহাজ হুমায়ুন কবীর বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, ভৈরবের সব ব্যবসায়ী সংগঠন জুয়েল হত্যার বিচার দাবিতে একাত্ম। আর এই বিচার আদায়ে যা করণীয় তা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় করবে।
পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিক আহমেদ সৌরভ বলেন, অপচিকিৎসায় জুয়েলের মৃত্যু হয়েছে, এটি এখন প্রায় প্রমাণিত। তারপরও জুয়েল হত্যা মামলার আসামিরা কীভাবে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়, পুলিশ প্রশাসনের কাছে আমার প্রশ্ন। তাই অনুরোধ করছি, অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার করুন।
জুয়েলের পরিবারের বিরুদ্ধে আদালতে দায়ের করা মামলার নিন্দা জানিয়ে আতিক আহমেদ বলেন, কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মিথ্যা মামলা করেছে। অথচ জুয়েলের পরিবার নয়, ঘটনার পর স্থানীয় ক্ষুব্ধ জনতাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ না করলে হাসপাতালের একটি ইটও থাকত না।
সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান কবির, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. জসীম উদ্দিন রবীন, উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অরুণ আল আজাদ, পৌর কাউন্সিলর আরেফিন জালাল রাজিব, হাজি মো. মোমেন মিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা মো. দেলোয়ার হোসেন দেলু, সাজ্জাদ ইবনে সুলায়মান, সাংবাদিক সুমন মোল্লা, পৌর যুবলীগের সাধারণ সমম্পাদক আল আমীন সৈকত, স্বেচ্ছাসেবক লীগনেতা শামীম আহমেদ খোকন, শিক্ষকনেতা মো. নজরুল ইসলাম রিপন, জুয়েলের পরিবারের সদস্য ইকরাম বক্স প্রমুখ।
গত ৪ জুলাই বৃহস্পতিবার রাতে ভৈরব শহরের কমলপুর এলাকার ট্রমা অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে ভাঙা হাতে ঢুকানো রড অস্ত্রোপচার করে অপসারণের সময় পোলট্রি ব্যবসায়ী জুয়েল মিয়ার মৃত্যু হয়। তিনি এলাকার দক্ষিণ চণ্ডীবের গ্রামের হাজি আলাল উদ্দিন মিয়ার ছেলে। ঘটনার পর ভুল চিকিৎসায় জুয়েলের মৃত্যু হওয়ার অভিযোগ এনে অর্থোপেডিক চিকিৎসক ডা. কামরুজ্জামান আজাদকে অবরুদ্ধসহ হাসপাতালটিতে ভাঙচুর চালায় ক্ষুব্ধ স্বজনসহ এলাকাবাসী।
খবর পেয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনিসুজ্জামানের উপস্থিতিতে পুলিশ, র্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে উত্তেজিত জনতাকে সরিয়ে ওই চিকিৎসককে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নেয়।
এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই কামাল মিয়া বাদী হয়ে ৫ জুলাই শুক্রবার বিকেলে অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. কামরুজ্জামান আজাদ, অবেদনবিদ ডা. মোহাম্মদ ইমরান, ওয়ার্ড বয় গৌরাঙ্গ রায় এবং হাসপাতালের পরিচালক মোশারফ হোসেনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
অপরদিকে হাসপাতালের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ১১ জুলাই বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জের বিচারিক হাকিমের আমল গ্রহণকারী আদালত ২-এ একটি মামলা করেন। মামলায় সাতজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয়ের ৮০ থেকে ৯০ জনকে আসামি করা হয়। এতে জুয়েল হত্যা মামলার বাদী নিহতের বড় ভাই কামাল মিয়া, অপর ভাই জামাল মিয়া ও কামরুল, চাচাতো ভাই ইকরাম বক্স, প্রতিবেশী মোস্তফা মোল্লা, মোশারফ মোল্লা ও মামা সজল মিয়াকে আসামি করা হয়।