রাতারগুলে মাছ ধরতে বিষ, মরছে সাপ-কাকড়াও
বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন রাতারগুলের প্রবেশ মুখ খইয়ার খালে বিষ দিয়ে মাছ মারার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত রোববার সকালে এ খালে সেই মরা মাছ ধরতে গ্রামবাসীর ঢল নামে। শুধু মাছ না, মরে ভেসে উঠতে দেখা গেছে কাকড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপও।
গত শনিবার, ১৭ অক্টোবর রাতে বিষ ঢেলে মাছ লুটের এ ঘটনায় বন বিভাগের লোকজনের যোগসাজশ আছে বলেও অভিযোগ বিভিন্ন মহলের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত শনিবার রাতে কে বা কারা এ খালে বিষ ঢেলে দেয়। এর প্রভাবে পরের দিন সকালে খালে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভেসে উঠতে দেখা যায়। আর তা ধরতেই খাল থেকে বনের ভেতর পর্যন্ত গ্রামবাসীর ঢল নামে। অনেককে আবার বনের গাছ কেটে বাঁধ দিয়েও মাছ ধরতে দেখা যায়। তবে বিষক্রিয়ায় শুধু মাছ মরছে না, মরছে অনেক জলজ প্রাণীও।
প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের এই ঘটনার কথা জানতে পেরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। তিনি জানান, সেখানে গিয়ে তিনি বন্যপ্রাণীর এ অভয়াশ্রমে প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে দল বেঁধে মাছ সংগ্রহ করতে দেখেন। গ্রামবাসী স্থানে স্থানে অস্থায়ী বাঁধ তৈরি করে বিভিন্ন প্রকার সরঞ্জাম ব্যবহার করে দিনব্যাপী মাছ সংগ্রহের ‘হরিলুটে’ অংশ নেয় বলেও জানান তিনি।
আব্দুল করিম কিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “রাতারগুল জলারবনের প্রাণবৈচিত্র্য যে ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌঁছেছে তা সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তিকে বোঝানো যাচ্ছে না । রাতারগুল জলারবনকে সুরক্ষায় অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ মতামতে ‘সোয়াম্প ফরেস্ট’ আইন প্রণয়ন করা হোক । এই বনের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে মাছসহ জলজ প্রাণী হত্যা বন্ধ করতে হবে।” প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ বিষয়ে সর্বোচ্চ পদক প্রাপ্তির সময় রাতারগুলে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডকে হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে বিষের প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির ২৭টি সাপের মৃতদেহ দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন বাপা হবিগঞ্জ শাখার যুগ্ম সম্পাদক ডা. এস এস আল আমিন সুমন।
এ ছাড়া খালের পানিতে বিষ ঢালার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ভেসে থাকা মাছ বা সাপের ময়নাতদন্ত করা জরুরি বলে জানিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা।
গ্রামবাসী মাছ ও জলজ প্রাণী ভেসে উঠতে দেখে তা তৎক্ষণাত বন বিভাগ ও পরিবেশকর্মীদের অবগত করেন বলে জানান। তবে সিলেট বন বিভাগের দাবি আজই তারা এ খবর পেয়েছে।
এ বিষয়ে সিলেটের বন কর্মকর্তা দেলোয়ার এনটিভি অনলাইনকে ফোনে বলেন, ‘আমরা আজই ঘটনাটা জেনেছি। বিষয়টি পর্যবেক্ষণে লোক পাঠানো হয়েছে। তারা বিষয়টি দেখে আসছে। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এ ছাড়া ওই এলাকায় একটি বিশেষ টহলদল পাঠানোর কথাও জানান তিনি।
বিশ্বে মিঠাপানির বনের সংখ্যা মাত্র ২২টি। সরকার একে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করলেও এ বনের রক্ষণাবেক্ষণে কোনো বিশেষ পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। বনের মাঝখানে ওয়াচ টাওয়ার করেই তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। এমনকি বন বিভাগের অধীন রাতারগুল বিট অফিসেও নেই লোকজন। দুজন গার্ডের একজন কিছুদিন আগের মারা গেছেন আর একজন দিয়ে কোনো রকমে ধুকে ধুকে চলছে বিট অফিস। আর এ বিট অফিসের প্রধান কর্তাব্যক্তির পদটি যে কবে থেকে শূন্য তা জানেন না খোদ বন কর্মকর্তাও।
এ বিষয়ে দেলোয়ার বলেন, ‘লোকবল সংকটের কারণে সেখানে লোক দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আমরা যত তাড়াতাড়ি পারি অন্তত এ জায়গায় লোক দিতে চেষ্টা করব।’
রাতারগুল বাঁচাও আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘ভূমি সন্তান বাংলাদেশ’-এর সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর বলেন, ‘একটা পক্ষ অভিযোগ করেছে যে বিষ দিয়ে মাছ মারা হয়েছে। আরেকটা পক্ষ বলছে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে নানা রকম উপকরণের কারণে অনেক সময় বিষক্রিয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনটা হয়েছে সে বিষয়ে বুঝতে পারছি না। আমাদের ল্যাবও নেই যে পানি পরীক্ষা করব। তবুও এখান থেকে পানি সংগ্রহ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।’
আশরাফুল কবীর বলেন, “এটা যেহেতু রিজার্ভ ফরেস্ট সেহেতু সরকারের দায়িত্ব অনেক। সরকার যতক্ষণ এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নেবে ততক্ষণ এখানে ‘হরিলুট’ হবে। স্থানীয় জনগণকে মাছ ধরার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে নিজেরা খাওয়ার জন্য মাছ ধরছি এটা কি দোষের কিছু? আমরা কিছু বলতে পারি না। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে।”
এ বনকে ১৯৭৩ সালে সংরক্ষিত ঘোষণা করে বন বিভাগ । বন বিভাগের তথ্য অনুসারে সিলেট বন বিভাগের উত্তর সিলেট রেঞ্জ ২-এর অধীন প্রায় ৩০ হাজার ৩২৫ একর জায়গাজুড়েই জলার বন। এর মধ্যে ৫০৪ একর জায়গায় মূল বন, বাকি জায়গা জলাশয় আর কৃষিজমি। তবে বর্ষাকালে পুরো এলাকাটিই পানিতে ডুবে থাকে। শীতে প্রায় শুকিয়ে যায় রাতারগুল। তখন কেবল পানি থাকে বনের ভেতরে খনন করা বড় জলাশয়গুলোতে। পুরনো দুটি বড় জলাশয় ছাড়াও ২০১০-১১ সালে রাতারগুল বনের ভেতরে পাখির আবাসস্থল হিসেবে ৩ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটারের একটি বড় লেক খনন করা হয়। শীতে এ জলাশয়ে বসে নানা পাখির মিলনমেলা।