অব্যবস্থাপনায় হুমকিতে রাতারগুল
বিশ্বে সোয়াম্প ফরেস্ট বা স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। এর মধ্যে উপমহাদেশে আছে দুটি। একটি শ্রীলঙ্কায়, আরেকটি বংলাদেশের সিলেটে। সিলেটের এই জলাবনের উত্তরে গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওর। এর মাঝেই জলাবন ‘রাতারগুল’। সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে এই জলাবনের অবস্থান। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ভাসমান এই বন অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতায় হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে।
সরজমিনে ঘুরে জানা যায়, মূলত সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলেও সেখানে অবাধেই যাতায়াত করছে পর্যটক ও স্থানীয়রা। কারেন্ট জাল ফেলে মাছ ও বনের অন্যান্য জলজ প্রাণী প্রতিনিয়ত ধরা হচ্ছে। পর্যটকরা রাতালগুলের পানিতে ফেলছেন নানা আবর্জনা। ফলে জমছে ময়লার স্তূপ। পাশাপাশি ইঞ্জিনের নৌকার শব্দদূষণ তো আছেন। ফলে রাতালগুলের অবস্থা এখন অনেকটাই ত্রাহি ত্রাহি। অথচ ৫০৪ একরের বিশাল এ বনের দেখভাল করার জন্য রয়েছে বন বিভাগের একজন মাত্র কর্মী।
গত ৩ অক্টোবর গোয়াইনঘাটের ফতেপুর ইউনিয়নে গুয়াইন নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তিনটি নৌঘাট রয়েছে। এগুলো হলো- মোটরঘাট, রাতারগুল ঘাট ও চিরিঙ্গি ঘাট। এর মধ্যে মোটরঘাট ও রাতারগুল ঘাট দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই শত শত পর্যটক নৌকা ও ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে প্রবেশ করছে রাতারগুল সংরক্ষিত বনাঞ্চলে।
মোটরঘাটে দেখা গেল, পর্যটক নিয়ে ৫০টিরও বেশি নৌকা রাতারগুল বনে প্রবেশের অপেক্ষা করছে। ছোট, বড় ও মাঝারি নৌকা অনুযায়ী পর্যটক প্রতি সর্বনিম্ন এক হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
মোটরঘাটের ইজারা নিয়েছেন কচির আলী। তিনি জানালেন, ছয় লাখ ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে এক বছরের জন্য ঘাটটি ইজারা নিয়েছে সূর্য এন্টারপ্রাইজ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছ থেকে তিনি আরো বেশি দরে ইজারা নিয়ে ব্যবসা করছেন। এ ছাড়া তাঁর ঘাটে ৬০ থেকে ৭০টি নৌকা রয়েছে। এর মধ্যে ইঞ্জিন নৌকা রয়েছে প্রায় ১০টি। পর্যটকদের নৌকা ভাড়ার ৬০ শতাংশ পান ঘাটমালিক আর ৪০ শতাংশ পান নৌকা বা ইঞ্জিন নৌকার মাঝি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, ২০১৪ সালে মোটরঘাটের গুদারা ঘাটের ইজারা ফি ছিল ১৬ হাজার টাকা। এখন তা নয় লাখ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। তবে সরকারকে ছয় লাখ টাকা দিতে হয় ইজারাদারদের। কিন্তু রাতারগুল জলার বন ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ অনুযায়ী বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। ফলে বনের ভেতর অবাধে প্রবেশের এ ক্ষেত্রে ইজারা দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু এখন দেওয়া হচ্ছে। এর মানে হলো, এই ঘাট থেকে প্রশাসনিকভাবে বনের ভেতর নৌকা নিয়ে প্রবেশে উৎসাহ দেওয়া হছে।
রাতারগুল জলার বনের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেল, অবৈধ মাছ শিকারিরা বনের খালের ভেতরে কারেন্ট জাল পেতে রেখেছে। আর এসব জালে আটকা পড়ছে সাপ, ব্যাঙ, লাল কাঁকড়া, মা মাছসহ নানা প্রজাতির জলজ প্রাণী। স্থানীয় মাঝিরা জানান, ‘প্রভাবশালী’ কতিপয় স্থানীয় ব্যক্তি এই কারেন্ট জাল পেতে মাছ শিকার করছে। কয়েকটি জাল তুলতেই দেখা গেল সাপ, ব্যাঙ, লাল কাঁকড়া, বিভিন্ন ধরনের মাছসহ নানা জলজ প্রাণী এতে আটকা পড়েছে।
এ সময় দেখা গেল বেড়াতে আসা পর্যটকরা অবাধে নৌকা নিয়ে যাতায়াত করছে। সেখানে নেই বন বিভাগের পাহারাদার। কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতির ও নজরদারি না থাকার ফলে পর্যটকরা বনের ভেতর চিপসের প্যাকেট, বিরিয়ানির প্যাকেট, পানির বোতল ফেলে গেছে। অপরদিকে বনের ভেতর বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিষিদ্ধ হলেও মানছে কেউই। বনের ভেতরে নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পর্যটকরা জোরে শব্দ করে সাউন্ড সিস্টেম বাজিয়ে হিন্দি গানের তালে নাচগানে মশগুল। অথচ এই বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে ১৯৮৫ সালে সরকার ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ অনুযায়ী এটিকে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
বনের ভেতরে বন বিভাগের নির্মিত ওয়াচ টাওয়ারের সামনে গিয়ে দেখা মিলল পর্যটকে কানায় কানায় পূর্ণ। টাওয়ারের চূড়ায় দেখা গেল একটি খাবারের দোকান। সেখানে চিপস, কলা, বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে দেদার। আর সেসব খাবারের প্যাকেট নিক্ষেপ করছে ভাসমান এই বনের পানিতে। ফলে দূর্ষিত হচ্ছে বনের পরিবেশ।
জলার বনে ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত কয়েক বছরে রাতারগুলে পর্যটকদের যাতায়াত বেড়েছে। আর অনিয়ন্ত্রিতভাবে পর্যটক আসায় এই বনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর আগের অবস্থায় নেই। বর্যা মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকা শাপলায় ছেয়ে থাকে। পর্যটকরা যত্রতত্রভাবে তা তুলে নিয়েছে। ফলে শাপলার পাতা ও মরা কলি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট পাওয়া গেল না।
রাতারগুলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় সংগঠন ‘ভূমি সন্তান বাংলাদেশ’ কয়েক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। সংগঠনটির দাবি, দীর্ঘদিন ধরেই রাতারগুল বনটি ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। দেশি-বিদেশি গবেষকরা বিভিন্ন সময়ে গবেষণা করলেও ২০১২ সাল থেকে বনটির ওপর পর্যটকদের আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে বিরল এই বনটির গুরুত্ব অনুধাবন না করে সোয়াম ফরেস্ট হিসেবে বনটিকে স্বীকৃতিদান না করেই এই বনকে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে বন বিভাগ। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবেই বনের ভেতর নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার আর অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট।
সংগঠনটির সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর এনটিভি অনলাইনকে বলেন, রাতারগুল বন একটি বিশেষ ধরনের বন। শুরু থেকেই সিলেটের সর্বস্তরের পরিবেশকর্মীরা সরকারের কাছে এই বন রক্ষায় বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণের মাধ্যমে সুর্নিদিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি করে আসছে। কিন্তু বন বিভাগ বন রক্ষার চেয়ে প্রকল্পবাজিতেই বেশি ব্যস্ত। তাই তাদের কাছে এই গাছ কাটা বা বনবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধ মুখ্য বিষয় নয়। কেননা এই বনটিকে তারা একটি পুরোদস্তুর পর্যটনকেন্দ্র বানানোর পাঁয়তারা করছে। অথচ এই বনটি পর্যটনকেন্দ্রের চেয়ে একটি প্রাকৃতিক জাদুঘর হওয়া উচিত। যেখানে বন গবেষণা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড চলবে।
আশরাফুল কবীর আরো বলেন, রাতারগুলে বনের ভেতর যাওয়ার প্রবেশমুখ কৈয়ার খালে গুয়াইন নদীর মা মাছের প্রজনন কেন্দ্র। আর স্থানীয়রা বনের ভেতরে ঢোকার প্রবেশ মুখে ও বনের ভেতর কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখে। ফলে প্রজননরত মাছ ও এই বনের জলজ প্রাণীরা এসব জালে আটকা পড়ছে।
বাপার নেতা আবদুল করিম কিম বলেন, ‘রাতারগুল বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম। ২০১২ সালে আমরা যখন সর্বপ্রথম সেখানে যাই তখন নানা রকমের জলজ প্রাণী ও পাখি দেখেছিলাম। কিন্তু এখন তা নেই। আগে বিছা, ব্যাঙ, সাপ ও লাল কাঁকড়া হরহামেশাই দেখা মিলত। কিন্তু বর্তমানে এসব সরীসৃপ নেই বললেই চলে। এ দায় অবশ্যই বন বিভাগকে নিতে হবে।
আগে রাতারগুল বনটিকে স্থানীয়দের কাছে লিজ দিত বন বিভাগ। ওই সময় শুকনো মৌসুম শুরুর আগে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এ দুই মাসে বনে প্রবেশের মুখগুলো জাল দিয়ে বাঁধ করে দিত। পরে পানি নেমে গেলে মাছ-কাঁকড়াসহ আহরণযোগ্য সবকিছু তারা নিয়ে যেত।
আবদুল করিম কিম জানান, পরে পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে লিজ প্রথা বাতিল করা হয়। কিন্তু বন বিভাগের অবহেলা ও নজরদারির অভাবে এখনো স্থানীয়রা অবৈধভাবে বনের মুখে কারেন্ট জাল দিয়ে বন্ধ করে মাছ আহরণ করছে। ফলে সাপ, ব্যাঙ এবং কাঁকড়াসহ নানা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলীন হচ্ছে। একসময় এখানে কাছিম ছিল কিন্তু এখন তা নেই। আর এভাবে যদি চলতে থাকলে এই বন তার বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারবে না।
রাতারগুল বনে পাখি, ছয় ইঞ্চি লম্বা বিছা (ছেঙ্গা), সাপের প্রাদুর্ভাব বড়ই বেশি বলেই শোনা গেলেও সরজমিনে ঘুরে তেমন কিছু দেখা যায়নি। নৌকার মাঝি জানালেন, যেদিকে মানুষের চলাচল সেদিকে কমছে বন্য প্রাণী ও পাখির সংখ্যা। রাতারগুলকে স্থানীয়রা ‘সুন্দরবন’ বলে ডাকে। এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে পর্যটনকেন্দ্র। বর্তমানে স্থানীয় লোকদের জীবিকা নির্বাহেরও এক বিশেষ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে রাতারগুল বন। শ্রমজীবীরা চায়, বনের পরিবেশ ভালো হোক, যাতে পর্যটকরা আসতে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু পরিবেশবিদদের মতে, পর্যটন কেন্দ্র হলে এই বনের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়বে।
রাতারগুলের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) দেলোয়ার হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ৫০৪ একর এলাকা নিয়ে বিশাল একটি বন। অথচ সেখানে পাহারা দেওয়ার জন্য বন বিভাগের লোকবল রয়েছে মাত্র একজন। আর লোকবল ছাড়া কখনোই এই বনকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। আমরা যে কত অসহায় তা বোঝানো সম্ভব নয়।
এ ছাড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকায় জেলা পরিষদের নৌ-ঘাট ইজারা প্রদান ও এই ঘাট দিয়ে রাতারগুল সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পর্যটক প্রবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘মোটরঘাট এলাকাটি রাতারগুল সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতার বাইরে। আর কারা এটি ইজারা দিয়েছে তা আমার জানা নেই।’
২০১৪ সালে ১৬ হাজার টাকা এবং চলতি বছর নয় লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া প্রসঙ্গে সিলেট জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান বলেন, প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার কারণেই মূলত ইজারামূল্য বেড়েছে।
রাতারগুলের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে যত্রতত্রভাবে নৌকা-ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে পর্যটক প্রবেশের কারণে পরিবেশদূষণ রোধে বন বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে জেলা পরিষদের কর্মকর্তা বলেন, ‘না, তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। আর প্রয়োজনও নেই। কারণ এটি জেলা পরিষদের আওতাধীন।’
বন বিভাগের তথ্য অনুসারে সিলেট বন বিভাগের উত্তর সিলেট রেঞ্জ-২-এর অধীন প্রায় ৩০ হাজার ৩২৫ একর জায়গা জুড়েই জলার বন। এর মধ্যে ৫০৪ একর জায়গায় মূল বন, বাকি জায়গা জলাশয় আর কৃষিজমি। তবে বর্ষাকালে পুরো এলাকাটিই পানিতে ডুবে থাকে। শীতে প্রায় শুকিয়ে যায় রাতারগুল। তখন কেবল পানি থাকে বনের ভেতরে খনন করা বড় জলাশয়গুলোতে। পুরোনো দুটি বড় জলাশয় ছাড়াও ২০১০-১১ সালে রাতারগুল বনের ভেতরে পাখির আবাসস্থল হিসেবে ৩ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটারের একটি বড় লেক খনন করা হয়। শীতে এ জলাশয়ে বসে নানা পাখির মিলনমেলা।