শেষ মুহূর্তে একে অপরকে জড়িয়ে ছিল বাবা ও ছেলে
ছোট ভাই অপু আর নিজের তিন বছর বয়সী ছেলে আরাফাতকে নিয়ে দোকান থেকে বের হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী। ছোট গলিতে হাঁটা শুরু করা মাত্রই শুনলেন বিকট শব্দ। কিছু বুঝতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাতেই ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে পড়েন মোহাম্মদ আলী।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোহাম্মদ আলীর লাশ যখন মর্গে রাখা হয়, তখনো দেখা যায় বাবা ছেলে একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে। ওই অবস্থাতেই মৃত্যু হয় তাদের। সঙ্গে থাকা ছোট ভাই অপুও প্রাণ বাঁচাতে পারেননি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে এসব কথা বলছিলেন মোহাম্মদ আলী ও অপুর আরেক ভাই দিপু। চকবাজারে তাঁদের কসমেটিকসের আছে। দিপু জানালেন, দুই ভাইকে জানিয়ে একটু আগেই বের হয়েছিলেন তিনি। খানিক যেতেই তিনি শোনেন বিকট শব্দ। তবে তিনি বেঁচে যান। পেছনে পরে থাকে দুই ভাই ও ভাতিজার লাশ।
দিপু এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রাত ১০টার থেকে একটি বেশি হবে। আমরা বন্ধুরা মিলে কাল (আজ ২১ ফেব্রুয়ারি) ঘুরতে যামু প্ল্যান করতেছি। এরমধ্যে দুই ভাইকে দোকানের চাবি দিয়ে বললাম ভাই আমি একটু আহি। ১০০ হাত দূরে যাওয়ার পর দেখলাম বিকট শব্দ। এরপর শুধু তাকাই দেখি শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। দেখি সাপের মতো আঁকা-বাঁকা হয়ে গলির মধ্যে আগুন সবাইকে দোঁড়াইত্যাছে। নিজেকে বাঁচাতে পা্রলেও আমার বড় দুই ভাই আর ছোট শিশু আরাফাত দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে।’
দিপু জানান, তাঁর দুই ভাই ও ভাতিজার শরীরে পোড়া বা অন্য কোনো ক্ষতের চিহ্ন নেই। বড় ভাই বিস্ফোরনের আওয়াজ শুনে কোনো গলির চিপায় বসে পড়েন। বাবুকে নিয়ে বসা অবস্থায় মারা যান।
দিপু বলেন, ‘আমরা কারো ক্ষতি করিনি। আমাগো তিনভাইকে সবাই বলত এরা বন্ধু। এত মিল ক্যামনে থাকে।’ কেবলই বিলাপ করছিলেন দিপু।
নিহত মোহাম্মদ আলীর বয়স ৩৩ বছর। ছোট ভাই অপুর বয়স ৩০। চকবাজার এলাকায় কসমেটিকসের ব্যবসা করতেন। সকালে তাদের বোন জরিনা বেগম ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে আহাজারি করছিলেন।
জরিনা আজ আহাজারি করতে করতে বলেন,‘আরাফাত,আমার কলিজার টুকরা,আমার কলিজার টুকরা মোহাম্মদ আলী, ওই কই গেল, কই গেল? ‘আমি কই পামু,ওই আরাফাত। এত মানুষ দেহি, অগো দেহি না ক্যা? অগো দেহি না ক্যা? মোহাম্মদ আলী কই গেল?’
চকবাজার এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত মারা গেছে ৭৮ জন। এদের অধিকাংশের লাশই ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আনা হয়েছে। সকাল থেকেই মর্গের সামনে আত্মীয়স্বজনদের ভিড় জমে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় আরো বাড়তে থাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, চকবাজারের নন্দকুমার সড়কের চুড়িহাট্টায় বুধবার রাতে শাহী মসজিদের সামনে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির ট্রান্সফরমার বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এর পরই পাশের খুঁটির আরো দুটি ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের শব্দ তারা শুনেছে। মুহূর্তেই আগুন লাগে জামাল কমিউনিটি সেন্টারে। আগুনের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলা ওয়াহিদ ম্যানশনে। ভবনটির প্রথম দুইতলায় প্রসাধন সামগ্রী, প্লাস্টিকের দানা ও রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদাম থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের আরো চারটি ভবনে। পাশের কয়েকটি খাবারের হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারেরও বিস্ফোরণ ঘটে। পুড়ে যায় সড়কে থাকা একটি প্রাইভেট কারসহ কয়েকটি যানবাহন। এ সময় পুড়ে যাওয়া কয়েকটি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
ঘটনাস্থলে দায়িত্বপালন করা ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যেহেতু এখানে দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ আছে, এগুলো খুবই বিস্ফোরণ ঘটছে। এগুলোর টেম্পার অনেক বেশি। এগুলোর সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে আমাদের ফায়ার ফাইটিং করতে হচ্ছে। আবাসিক এলাকায় কোনো কেমিক্যালের গোডাউন থাকার কথা না।’
চকবাজার এলাকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন সংযোগ সাময়িক বিচ্ছিন্ন করে আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।