‘ডেডবডিগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়’
‘রাত দেড়টার দিকে ওরা একজন ওয়েটার এবং একজন ফরেনারকে বের করে নিয়ে আসে। ওয়েটারকে সরিয়ে ফরেনারকে সরাসরি গুলি করে। আর আমাদের আশপাশে পড়ে থাকা ডেডবডিগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। রমজান মাস, যখন সেহরির সময় হয়, তখন তারা আমাদের সেহরির ব্যবস্থা করে। পরিস্থিতি খাবার উপযোগী ছিল না।’
গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত শারমিনা পারভীন আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় এসব কথা বলেন। আজ বুধবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালতে তিনি এ সাক্ষ্য দেন।
শারমিনা ছাড়াও আজ আরো সাক্ষ্য দেন ঘটনাস্থলে নিহত এসি রবিউল ইসলামের ভাই শামসুজ্জামান ও তাঁর খালাতো ভাই মোল্লা মো. আনোয়ারুল আমিন। আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বিষয়টি এনটিভি অনলাইনকে জানান।
শারমিনা পারভীন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের স্ত্রী।
আইনজীবী ফারুক জানান, আজ আদালতে হাসনাত করিমের স্ত্রী শারমিনা পারভীন সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ‘২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত ৮টার দিকে স্বামী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় যাই। মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সেখানে আমরা ডিনার করতে যাই। হলি আর্টিজানের হল রুমের শেষের টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। মেন্যু দেখে খাবারের অর্ডার দেই। তিন-চার মিনিট পর তিন-চারজন অস্ত্রসহ কাধে ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করে। তারা গুলি করতে থাকে। এরপর আমাদের টেবিলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে আমরা মুসলিম কি না। আমরা মুসলমান জানালে তারা বলে, আপনারা মুসলমান আপনাদের কোনো ক্ষতি করব না। আপনারা মাথা নিচু করে টেবিলে বসে থাকুন।’
পারভীন জবানবন্দিতে বলেন, ‘বেকারিতে গ্লাসঘেরা রুমে আনুমানিক ৮-১০ জন বা তার বেশি ফরেনার বসা ছিলেন। তাদের ওপর তারা গুলি করা শুরু করে। তারা আমাদের বলে, আপনাদের ছেলেমেয়েদের চোখ-কান বন্ধ করে রাখেন যেন তারা কোনো কিছু দেখতে বা শুনতে না পায়। আমি তাদের চোখ-মুখ বন্ধ করে রাখি।‘ তিনি জবানবন্দিতে আরো বলেন, কিছুক্ষণ পর তারা একটা ছেলে, দুটো কম বয়সী মেয়েসহ চারজনকে আমাদের টেবিলের কাছে নিয়ে আসে। আমাদের সারারাত মাথা নিচু করে টেবিলে বসিয়ে রাখে। বারান্দার একটা লাইট বাদে হলরুমের সব লাইট বন্ধ করে দেয়। রাত দেড়টার দিকে একজন ওয়েটার এবং একজন ফরেনারকে বের করে নিয়ে আসে। ওয়েটারকে সরিয়ে ফরেনারকে সরাসরি গুলি করে। আর আমাদের আশপাশে পড়ে থাকা ডেড বডিগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। রমজান মাস, যখন সেহরির সময় হয়, তখন তারা আমাদের সেহরির ব্যবস্থা করে। পরিস্থিতি খাবার উপযোগী ছিল না। তারা বারবার আমাদের জিজ্ঞাসা করে, খাচ্ছি না কেন। তারা ধমক দেয় তাই এক কামড় খাবার খেয়েছিলাম। এরপর রাতে আমাদের অস্ত্রের মুখে বসিয়ে রাখে।’
পারভীন আরো বলেন, ‘ভোরে আমার স্বামী এবং আরেকটি ছেলে তাহমিদকে ছাদে নিয়ে যায়। এরপর তাদের আবার টেবিলে এনে বসায়। আমার স্বামীকে চাবি দিয়ে বাইরের গেটের তালা খুলে আসতে বলে। তালা খুলে আসার পর বলে আপনারা এক এক জন করে বের হয়ে যান। বের হয়ে আসার আগে মোবাইল ফোনসহ যা যা নিয়েছিল তা ফেরত দেয়। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে প্রথমে আমরা আটজন বের হয়ে আসি। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের নিরাপদ হেফাজতে নিয়ে যায়। পরে আমাদের ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।’
সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে বিচারক আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেন। এদিকে আজ এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ উপলক্ষে কারাগারে থাকা ছয় জঙ্গিকে হাজির করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান ও হাদিসুর রহমান সাগর। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আলোচিত মামলাটির বিচার শুরুর নির্দেশ দেন একই আদালত। ২০১৮ সালের গত বছরের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর গুলশান হামলা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়। পরে অবশ্য হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েস।
এ মামলায় অভিযোগপত্রে ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আটজন আসামি বিভিন্ন অভিযানে ও পাঁচজন হলি আর্টিজানে অভিযানের সময় নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া জীবিত আটজনের মধ্যে ছয়জন কারাগারে এবং বাকি দুজন পলাতক। পলাতক দুই আসামি হলেন শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় বন্দুকধারীরা। হামলার পর রাতেই তারা ২০ জনকে হত্যা করে।