পদ্মাপাড়ে লাশের অপেক্ষায় স্বজনরা
পদ্মায় লঞ্চ ডুবির তৃতীয় দিন আজ। নিখোঁজদের সন্ধানে পাটুরিয়ায় পদ্মার পাড়ে ঘুরছেন স্বজনরা। প্রিয় মানুষকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার আশায় এখানে রাত-দিন পার করছেন তাঁরা। এদিকে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দুর্ঘটনা এলাকা থেকে চার কিলোমিটার ভাটিতে আরো একজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত এ দুর্ঘটনায় মোট ৭১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, এখনো ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজন নারী, ছয়জন পুরুষ ও একজন শিশু।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে শিবালয় উপজেলার ছোট বোয়ালী গ্রামের সুবল সূত্রধরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উপজেলার মান্দাখোলা এলাকায় তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়। সুবলের (৭০) পকেটে একটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। এই মোবাইলের মাধ্যমেই তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গত রোববার সকালে মাঝ পদ্মায় সারবোঝাই কার্গো নার্গিস-১ এর সঙ্গে ধাক্কায় দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে ‘এমভি মোস্তফা’ ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনায় এখনো নিখোঁজ রয়েছেন মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে আবুল হাশেম হাসু (৫৫), ঘিওর উপজেলার চর কুশুণ্ডা গ্রামের মান্নু মিয়া (৬৫), দৌলতপুর উপজেলার সমেতপুর গ্রামের ইমন মোল্লা (৩৫), শিবালয় উপজেলার ছোট বোয়ালী গ্রামের সঞ্চিত সূত্রধর (২৫), নড়াইলের লোহাডাঙ্গা উপজেলার লক্কচর গ্রামের হামিদা বেগম (৫০), লোহারগাথি এলাকার আনোয়ারা বেগম (৫৬), ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার দলিলপুর গ্রামের শিশু মারুফা খাতুন (৬), ফরিদপুরের ভাংগা উপজেলার বড় মুনকিন্নি গ্রামের জুয়েল রানা (২৭), কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার যাদবপুর গ্রামের লিপি আক্তার (২২) ও ঢাকার বাসাবো এলাকার ব্র্যাক কর্মকর্তা মোস্তফা মেহফুজ (৩৫)।
মঙ্গলবার পদ্মার পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনরা পদ্মার পাড়ে আহাজারি করছেন। তাঁরা যেকোনোভাবেই হোক, প্রিয় মানুষটির লাশ নিয়ে হলেও বাড়ি ফিরতে চান।
ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার দলিলপুর গ্রামের নাজমুল হোসেন ও পারভীন আক্তারের শিশুকন্যা মারুফা খাতুনের খোঁজে এসেছেন তাঁর ফুফা আব্দুল মান্নান। মারুফার পাশের গ্রামেই মান্নানের বাড়ি। তিনি এনটিভি অনলাইনকে জানান, মারুফা তাঁর মা-বাবার সঙ্গে সাভারের নবীগঞ্জে থাকেন। তিনি বেড়ানোর জন্য নবীগঞ্জে এসেছিলেন। তিন দিন সেখানে থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় মারুফাও গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদির কাছে যাওয়ার বায়না ধরে। সে কান্না জুড়ে দেয়। একপর্যায়ে মারুফাকে নিয়েই তিনি বাড়ি রওনা দেন।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আব্দুল মান্নান জানান, তিনি আর মারুফা লঞ্চের কেবিনে ছিলেন। হঠাৎ একটি বিকট শব্দ হয়। তারপরই কেবিনে পানির তোড় দেখতে পান। এ সময় মারুফা তাঁর হাত থেকে ছুটে যায়। তিনি কোনোমতে কেবিনের জানালা দিয়ে বের হয়ে আসতে পারলেও মারুফা ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন।
আব্দুল মান্নানের মতোই বোন লিপি আক্তারের খোঁজে দিগ্বিদিক ছুটছেন ভাই হাফিজুর রহমান। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে আবুল হাশেম হাসুর (৫৫) খোঁজ করছেন তাঁর মেয়ের জামাই হাবিবুর রহমান। ঢাকা থেকে গিয়েছেন বাসাবো এলাকার নিখোঁজ ব্র্যাক কর্মকর্তা মোস্তফা মেহফুজের ভাই তানভীর আহমেদ হীরা।
এনটিভি অনলাইনকে হীরা জানান, তাঁর ভাই মোস্তফা মেহফুজ আরো দুই সহকর্মীর সঙ্গে অডিটের কাজে রাজবাড়ী যাচ্ছিলেন। পথে লঞ্চ দুর্ঘটনায় অন্য দুজন বেঁচে গেলেও এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন মেহফুজ। হীরা আরো জানান, পাটুরিয়ায় নৌপুলিশ ফাঁড়িতে লঞ্চ থেকে উদ্ধার হওয়া মালামাল রাখা হয়। তিনি সেখানে গিয়ে ভাইয়ের ব্যাগটি পেয়েছেন। ব্যাগের ভিতরে থাকা ব্র্যাকের পরিচয়পত্র দেখে ব্যাগটি মেহফুজের বলে নিশ্চিত হয়েছেন হীরা।
জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস জানান, নিখোঁজদের উদ্ধারে নদীতে ফায়ার সার্ভিস, বিআইডব্লিউটিসি ও নৌপুলিশ এখনো কাজ করছে। সব যাত্রীকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতা চলবে।
শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুজ্জামান বলেন, লঞ্চ দুর্ঘটনায় শিবালয় থানায় গতকাল সোমবার রাতে একটি মামলা হয়েছে। পাটুরিয়া ঘাট নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল মোকতাদির বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে নার্গিস-১ কার্গোর মাস্টার ইকবাল হোসেনসহ আটক চারজনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।