নিজেদের মধ্যকার বিভেদ নিরসন করুন : হাইকোর্ট
নিজেদের মধ্যে মারামারির পর বিশ্ব ইজতেমা পালনে আদালতের নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের করাকে ‘লজ্জার’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ‘নিজেদের মধ্যকার বিভেদ নিরসন করুন।’
এ সংক্রান্ত রিট আবেদনের শুনানিকালে আজ মঙ্গলবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী শাহ মো. নুরুল আমিন এবং রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত রিটকারী পক্ষের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা নিজেরা দুই ভাগে বিভক্ত হলে দ্বীনের প্রচার করবেন কীভাবে? নিজেদের মধ্যে মারামারি করবেন, আবার ইজতেমা পালনের জন্য আদালতে রিট দায়ের করবেন, এটা লজ্জার। আগে নিজেরা সংশোধন হন, সুস্থ হন এবং নিজেদের মধ্যকার বিভেদ নিরসন করুন। তারপরই আপনাদের আবেদন শুনব।'
এরপর রিটকারীর আইনজীবী শাহ মো. নুরুল আমিন আদালতকে বলেন,‘দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা চলছে। তবে দ্বন্দ্ব নিরসন সম্ভব না হলে সরকার দুই পক্ষকে আলাদা-আলাদাভাবে ইজতেমা পালনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন তাই পালন করা হবে।’
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু আদালতকে জানান, আগামীকাল বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি জরুরি সভার তারিখ নির্ধারণ রয়েছে। ইজতেমার বিষয়ে সেখান থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসতে পারে।
রাষ্ট্রপক্ষের এই শুনানির পর মামলাটির পরবর্তী শুনানি ও শুনানি শেষে আদেশের জন্য আগামী ২৭ জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করেন হাইকোর্ট।
এর আগে গত ২১ জানুয়ারি টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিটটি দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. ইউনুস মোল্লা। রিট আবেদনে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ তিন জনকে বিবাদী করা হয়।
রিট আবেদনে বাংলাদেশে তাবলিগের কার্যক্রম শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়ে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহাল চাওয়া হয়। একইসঙ্গে ১৮ সেপ্টেম্বরের পরিপত্র স্থগিত করে একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর জারি করা পৃথক আরেকটি পরিপত্র কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আবেদন জানানো হয়।
তাবলিগ জামাতের দুটি গ্রুপের মধ্যে চলমান বিরোধ মিটিয়ে বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের উদ্যোগ নেয় সরকার। এ সিদ্ধান্তের কথা জানার পর গত ১৭ জানুয়ারি দেওবন্দ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সেখানে তাবলিগ জামাত নিয়ে সব ধরনের সভার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এক পরিপত্র জারি করা হয়। উপসচিব দেলোয়ারা বেগম স্বাক্ষরিত ওই পরিপত্রে উভয় গ্রুপের জন্য পাঁচ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্তের আলোকে জারি করা আরেক পরিপত্রে বলা হয়, ‘সমগ্র বিশ্বে তাবলিগের কার্যক্রম একটি অরাজনৈতিক, অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় কার্যক্রম হিসেবে পরিচিত। মুসলমান জনসাধারণ তাদের আত্মশুদ্ধি ও ইসলামের দাওয়াতের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে আসছে। এ কার্যক্রমে বাংলদেশ একটি অগ্রসরমান দেশ বিধায় দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম জামাত বিশ্ব ইজতেমা প্রতিবছর গাজীপুর জেলার টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সম্প্রতি এ সংগঠনের মধ্যে দৃশ্যমান বিভক্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে সংগঠনের দুটি গ্রুপের মধ্যে দেশের প্রায় সব এলাকায় প্রায়ই বিবাদ লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা ধর্মীয় রীতিনীতি তথা সার্বিক শান্তি শৃঙ্খলার অন্তরায়। তাই দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, ধর্মীয় সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখা তথা সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণে পাঁচ দফা নির্দেশনা জারি করা হলো।’
নির্দেশনায় বলা হয় :
ক. তাবলিগে বিদ্যমান দুটি পক্ষ সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা/পরামর্শক্রমে কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গী ইজতেমা ময়দানসহ দেশের সবজেলা ও উপজেলা মারকাজে সপ্তাহের ভিন্ন ভিন্ন দিনে/তারিখে তাদের কার্যক্রম (সাপ্তাহিক বয়ান ও রাত্রি যাপন, পরামর্শ ও তালিম, মাসিক জোড় ইত্যাদি) পরিচালনা করবে। তবে কোন পক্ষ চাইলে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে পরামর্শক্রমে মারকাজ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে/জায়গায়ও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
খ. তাবলিগের আদর্শ ও চিরাচরিত রীতিনীতি অনুযায়ী কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে কোনোরূপ লিখিত বা মৌখিক অপপ্রচার চালাবে না।
গ. দেশের সকল মসজিদে পূর্বের ন্যায় শান্তিপূর্ণভাবে দাওয়াতি কাজ পরিচালিত হবে। সে লক্ষ্যে যেকোনো মসজিদে উভয়পক্ষের জামাতই যেতে পারবে। এতে কোনো পক্ষই কাউকে বাধা দিবে না। তবে একই সময়ে দুই পক্ষের দেশি ও বিদেশি জামাত একই মসজিদে অবস্থান করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। এ ক্ষেত্রে যে পক্ষ আগে আসবে সেই পক্ষের জামাত অবস্থান করবে। অন্যপক্ষের জামাত পার্শ্ববর্তী অন্য কোনো সবিধাজনক মসজিদে চলে যাবে।
ঘ. উভয়পক্ষ তাদের ইজতেমা/জোড়ে তাবলিগের দেশি-বিদেশি মুরব্বিদের আমন্ত্রণ জানাতে পারবে। এতে একপক্ষ অন্যপক্ষের কার্যক্রমে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।
ঙ. কোনো এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে স্থানীয় প্রশাসন উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। পরবর্তী সময়ে একই মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আবুল কালাম আজাদের স্বাক্ষরিত ১৮ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রের কার্যকারিতা স্থগিত করে ২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আরেকটি পরিপত্র জারি করা হয়। এ অবস্থায় উভয় গ্রুপের মধ্যে বিরোধ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত গতবছর ১ ডিসেম্বর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে একজন নিহত ও অসংখ্য মুসল্লি আহত হন। সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।